“একটি দিনের দিনলিপি” রচনাটি এই ব্লগে সুন্দরভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। যারা Class 7, 8, 9, 10, SSC ও HSC এর শিক্ষার্থী, তাদের জন্য খুবই সহজ ভাষায় লেখা হয়েছে। পুরো রচনাটি একবার পড়ে দেখো, ভালো লাগবে।
একটি দিনের দিনলিপি রচনা
প্রতিটি নতুন দিনের পিছনে রয়ে যায় একটি পুরোনো দিন। নতুন দিনের আগমনে পুরোনো দিনের স্মৃতিগুলো হয়ে যায় অতীত। এই অতীতকে আমরা সংরক্ষণ করি আমাদের দিনলিপিতে। একটি দিনের ভালো লাগা মুহূর্তগুলো দিয়ে সাজানো হয় দিনলিপি। নিজ জীবনের প্রতিদিনের ঘটনাবিন্যাস স্থান পায় দিনলিপিতে।
আজ ১৬ ডিসেম্বর। দুপুর বারোটার দিকে দিনটি শুরু হয়েছিল একটু অন্যভাবে। ভোরে উঠেছি বাবার ডাকে, ফুল দিতে যেতে হবে শহীদ মিনারে। বাবা একজন মুক্তিযোদ্ধা। তাই এই দিন বাবাকে নানা কর্মসূচিতে অংশ নিতে হয়। ছোটবেলা থেকে বাবার সাথে আমিও অংশ নেই এ কর্মসূচিগুলোতে। এবার আমি একটু আগেই ফিরে এসেছি বাসায়। বাবার জন্য অপেক্ষা করছিলাম।
বাবা এলো হাস্যোজ্জ্বল মুখে। এই দিনটিতে বাবা খুব উৎফুল্ল থাকেন। বাবার কাছে জানতে চাইলাম, ‘বাবা, প্রতিবছর দেখি এই দিনে তোমার মধ্যে অন্যরকম আনন্দ কাজ করে; কারণ কী, বাবা?’ বাবা বলল, আনন্দে থাকব না! এদিন যে আমাদের গৌরবের দিন। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর আমাদের সকল পরাধীনতা ঘুচে গেছে। এই পরাধীনতার গ্লানি যে কী, তুই বুঝবি না। একই দেশ, তবু সব ক্ষেত্রে বৈষম্য। সব ক্ষেত্রে বঞ্চিত হয়েছি আমরা। তোর দাদু শিক্ষিত মানুষ ছিলেন। ব্যাংকে চাকরি করতেন কিন্তু তাকে বিনা কারণে বরখাস্ত করা হলো। এতগুলো ভাই-বোনের এই সংসারে যে কী দুর্যোগ নেমে এলো, তা তোকে বলে বোঝানো যাবে না। বাবার কথা শুনে বলে উঠলাম, সত্যি বাবা? বাবা বলল, এ তো তোকে শুধু ঘরের কথা বললাম, দেশের কথা তো বলাই হলো না।
একটু পর মায়ের ডাকে বাবাকে উঠতে হলো স্নানের জন্য। কিন্তু আমি ঠায় বসে আছি বাবার কাছে বাকি গল্প শোনার জন্য। কিছুক্ষণের মধ্যেই বাবা ফিরে এলা স্নান সেরে। বলল, জানিস, যেদিন শেখ মুজিব ভাষণে স্বাধীনতার ডাক দিলেন, সেদিনি ঠিক করেছিলাম যুদ্ধ করব। বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়েছিল পুরো দেশ। তখন আমরা তরুণ, তোর বয়সী। বঙ্গবন্ধুর ভাষণে মনে জাগলো কঠিন প্রত্যয়। সিদ্ধান্ত নিলাম, যুদ্ধ হলে আমি যুদ্ধ করব। যেমন ভাবনা, তেমন কাজ। যুদ্ধ শুরু হলে ভারত থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে অস্ত্র হাতে যুদ্ধে যোগ দিলাম। খাবার সময় হয়ে গেছে। বাবা বলল, চল খেতে খেতে তোকে বাকি গল্প শোনাই।
বাবা বললেন, “সারা দেশে আগুন জ্বলছিল। মিলিটারিরা সবকিছু ছাই-ছড়ি করে ফেলেছিল। সাথে যোগ দিয়েছিল রাজাকার-আলবদর বাহিনী। আমি তোর দাদু, ঠাকমা আর পিসিদের নিয়ে ভারতে গিয়েছিলাম। ভাবিস না, খুব আরামে গেছি। কিন্তু মাইলের পর মাইল হেঁটেছি, কিছুটা গরুর গাড়িতেও চড়ে গিয়েছি। তারপর আবার অনেকটা পথ হাঁটতে হয়েছে। তিন দিন পর ভারতে পৌঁছলাম। দাদু ও ঠাকমাদের রেখে আমি প্রশিক্ষণ নিতে গেলাম। প্রশিক্ষণ শেষ করে গ্রামে ফিরার পথে দেখি মিলিটারিরা এসেছে। একদিন পাটের খেতে লুকিয়ে থাকতে হয়েছিল। হঠাৎ দেখি সেই মাঠে আগুন জ্বালিয়েছে মিলিটারিরা। উপায় না পেয়ে নদীর মধ্যে ডুবে ছিলাম প্রায় ১০ ঘণ্টা।” বাবা বলতে বলতে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।
হঠাৎ বিকাল তিনটার দিকে বাবার ফোন বেজে উঠল। “মুক্তিযোদ্ধা সংসদে বিকেলের অনুষ্ঠানের কথা মনে করিয়ে দিতে কাকু ফোন দিয়েছেন,” ফোন রেখে বললেন, “আমি ৭ নম্বর সেক্টরে যোগ দিয়েছিলাম। প্রথমে গুপ্তচর হিসেবে কাজ করলাম, তারপর আগস্ট মাসের শেষ দিকে অস্ত্র হাতে লড়াই করেছি। কত ভীতিকর দৃশ্য দেখেছি! চারদিকে লাশ আর লাশ। নদীর জল খেতে গিয়ে ভেসে যাওয়া লাশগুলো দেখেছি। একদিন সারা দিন মিশন শেষে মাঝরাতে খেতে বসেছি, হঠাৎ মিলিটারিরা এসে গেছে, খাবার রেখেই চলে গেছে।” বাবার মুখ তখন কালো হয়ে এসেছিল। দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বললেন, “মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসাটা শুধু স্রষ্টাই জানেন কিভাবে সম্ভব হয়েছে। এসময় খবর পেলাম তোর ঠাকুমার কলেরা হয়েছে, অবস্থা খুব খারাপ। কিন্তু দেশমাতাকে ফেলে নিজের মাকে দেখতে যাওয়া সম্ভব হয়নি।”
বাবার গল্প শেষ হতে হতে বিকাল চারটা বেজে গেল। তিনি উঠে গেলেন। আমি বললাম, “বাবা, ভাবতেই কষ্ট হয় সেই দিনগুলোর কথা। সবাই কত কষ্টে ছিল, জীবন কত অনিশ্চিত ছিল।” বাবা হেসে বললেন, “তুই বলেছিলি কেন আমি এত উৎসাহী? কারণ আমি আমার কষ্টের মূল্য পেয়েছি। স্বাধীনতার পর সরকারের পক্ষ থেকে আমাদের সংবর্ধনা দেওয়া হয়। এটা কত সম্মানের, গর্বের বিষয় সেটা বোঝানো যায় না। যদিও সব স্বপ্ন এখনো পূরণ হয়নি, কিন্তু একদিন হবে, দেখবি। এত ত্যাগ কখনো বৃথা যাবে না।” বাবা বললেন, “আজ থাক, সময় হয়ে গেছে, যাই অনুষ্ঠানে।” বাবা উঠে গেলেন, কিন্তু আমি তখনও সেই দিনগুলোর কথা ভাবছিলাম।
এভাবেই কেটে গেল ১৬ ডিসেম্বরের দিনটি। বাবার গল্পগুলোর মধ্য দিয়ে আমি অতীতের ইতিহাস জানতে পারলাম। বাবার মুখে শোনা ঘটনাগুলোকেই আমি দিনলিপিতে বন্দি করে রাখলাম।
এই ছিল একটি দিনের দিনলিপি রচনা। আরও সহজ ও ভালো রচনা পড়তে চাইলে ভিজিট করো আমার ওয়েবসাইট — StudyTika.com। এখানে আরও অনেক রচনা রয়েছে তোমার জন্য।