প্রিয় পাঠকবৃন্দ, আজ আমরা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলোচনা করব: গণতন্ত্র। গণতন্ত্র আমাদের সমাজের ভিত্তি গঠন করে এবং এর মূল তত্ত্ব ও বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে জানলে আমরা আরও ভালোভাবে বুঝতে পারব কীভাবে আমাদের শাসন ব্যবস্থা কাজ করে।
এই ব্লগ পোস্টে আমরা গণতন্ত্রের মূল ধারণা, বৈশিষ্ট্য এবং এর সুবিধা-অসুবিধা সম্পর্কে বিস্তারিত জানব। আসুন, এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি জানার জন্য একসাথে চলি।
গনতন্ত্র কাকে বলে?
গণতন্ত্র : গণতন্ত্রের প্রতিশব্দ ডিমোক্রাসি (Democracy)। এটি গ্রিক শব্দ Demos এবং Kratos থেকে উদ্ভূত হয়েছে। Demos অর্থ জনগণ এবং Kratos এর অর্থ শাসন বা কর্তৃত্ব। তাই বুঝা যায় গণতন্ত্রের বুৎপত্তিগত অর্থ হল জনগণের শাসন। যে ব্যবস্থায় জনগণের প্রাধান্য রক্ষিত হয় তাকে গণতান্ত্রিক শাসন বলে। সর্বপ্রথম গ্রিক ঐতিহাসিক থুসিডাইস শব্দটি ব্যবহার করেন।
যে শাসনে সর্ব সাধারণের অংশগ্রহণের সুবিধা থাকে তাকে গণতন্ত্র বলে। গ্রিস ঐতিহাসিক হেরোেডটাস এ সম্পর্কে বলেন, 'গণতন্ত্র এমন এক শাসন ব্যবস্থা যেখানে শাসন ক্ষমতা কোনো এক বিশেষ শ্রেণীর হাতে অর্পিত না থেকে সমাজের সমস্ত লোকের ওপর অর্পিত থাকে।' অধ্যাপক শেলি বলেন, গণতন্ত্র এমন এক সরকার যাতে প্রত্যেকের অংশগ্রহণের সুবিধা আছে।
গণতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য গুলো কি কি
গণতন্ত্র একটি আদর্শ শাসন ব্যবস্থা কেননা বৈশিষ্ট্যসমূহ আলোচনা করলে এর গুরুত্ব অনুধাবন করা সম্ভব হবে। নিম্নে গণতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য আলোচনা করা হল:
- প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটাধিকার: গণতন্ত্র জনগণের শাসন হলেও সরকার গঠিত হয় প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটাধিকারের ভিত্তিতে। সরকারের ক্ষমতার মূল উৎস হল প্রাপ্তবয়স্কদের রায়। স্যার স্টাপল ক্রিপস গণতন্ত্র বলতে বুঝিয়েছেন এমন এক শাসন পদ্ধতি, যেখানে প্রাপ্তবয়স্ক সমস্ত নাগরিক মত প্রকাশের অধিকার লাভ করে।
- নিয়মতান্ত্রিক সরকার পরিবর্তন: সরকার যেমন নিয়মতান্ত্রিকভাবে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়, তেমনি পরিবর্তনের ধারাও হবে নিয়মতান্ত্রিক। অনিয়ম, বিশৃঙ্খলা ও বিপ্লব প্রযোজ্য নয়। নির্দিষ্ট সময় পর সরকার নির্বাচনের ধারায় পরিবর্তিত হয়। সরকার পরিবর্তনের একটাই পথ তা হল নির্বাচন এবং নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় নির্দিষ্ট সময়কাল পর।
- দলীয় অধিকার: গণতান্ত্রিক শাসন দলীয় আদর্শে বিশ্বাসী। একাধিক দলের অস্তিত্ব বর্তমান থাকে। জনগণ প্রয়োজনবশত দল গঠন এবং যে কোনো দলের সমর্থক হতে পারে। বিরোধী দলের কার্যক্রমকে অবশ্যই স্বীকৃতি দিতে হবে। মিলের মতে, বিরোধী দল না থাকলে গণতন্ত্র চলতে পারে না।
- মত প্রকাশ: গণতন্ত্রে জনগণের মত প্রকাশের অবাধ অধিকার থাকে। জনগণ ইচ্ছাগতভাবে সরকারের পক্ষে বা বিপক্ষে মত প্রদান করতে পারে। তাই জনগণের মত প্রকাশের অধকার থাকতে হবে। মাও সেতুংয়ের কথায়, 'শত পুষ্পের বিকাশ সম্ভব হোক; শত মতের মধ্যে সুস্থ প্রতিযোগিতা চলুক।' কেবল গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাতেই এটি সম্ভব।
- স্বার্থ সংরক্ষণ: সকল শ্রেণীর মানুষের স্বার্থ সংরক্ষণ সরকারের প্রধান দায়িত্ব। গণতন্ত্রে বর্ণ, গোত্র ও ধর্মের কোনো বিভেদের রেখা টানা যায় না। গণতন্ত্র মানেই হল সর্বসাধারণের সরকার, তাই সরকারের ধারণার মধ্যে এই ভাবধারা মূর্ত হয়ে ওঠে।
- ন্যায়বিচার: এই ব্যবস্থার অন্য একটি বৈশিষ্ট্য হল সমাজের সকল স্তরে ন্যায়বিচারের আদর্শ প্রতিষ্ঠা করা। ন্যায়বিচার সুনিশ্চিত করতে না পারলে গণতন্ত্র চলতে পারে না। স্বৈরশাসনের অধীনে ন্যায়বিচার পাওয়া যায় না। গণতন্ত্র হল আইনের শাসন এবং শাসনের আইনের কেবল ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা সম্ভব।
- আইনের শাসন: আইনের চোখে সবাই সমান। আইনগতভাবে নাগরিকদের মধ্যে কোনো প্রকার বিমাতাসুলভ আচরণ করা যায় না। একই আইনের আওতায় সকল নাগরিককে বসবাস করতে হয়। আইন সকলের জন্য যেন সম ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে পারে তার পথ করতে হবে। জে. এস. মিলের মতে, 'সভ্য সমাজে ব্যক্তি স্বাধীনতার জন্ম হয় আইনের শাসন থেকে।' গণতন্ত্র আইনের শাসন-এটি ব্যক্তির শাসন নয়।
- পরিশেষে: অর্থনৈতিবিদ সলটু বলেন, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় মতের দ্বন্দ্ব, অভ্রান্ত সত্য বলে না চালানো, আইনের চোখে সকলের সমান অধিকার এবং শান্তিপূর্ণ ও নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে সরকার পরিবর্তন সরকারের মূল বৈশিষ্ট্য।
গনতন্ত্রের অসুবিধা গুলো কি
বর্তমানকালে গণতন্ত্র যে একমাত্র আদর্শ শাসন সে কথা আর কেউ অস্বীকার করতে পারে না। এর বহু সমালোচনা আছে, তবে সেসব মূল্যায়ন করা আবশ্যক, অন্যথায় এ সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণা থেকে যাবে। গণতন্ত্রকে নিম্নমানের শাসন হিসেবে অভিহিত করা হয়, কেননা কম মেধাসম্পন্ন নেতৃবৃন্দ সাধারণ মানুষের প্রতিনিধিত্ব করে।
সাধারণ মানুষের অধিকাংশই দরিদ্র, অভাবগ্রস্ত ও অশিক্ষিত, বিধায় তাদের দ্বারা নির্বাচিত ব্যক্তি কোনোদিন যোগ্যতাশালী হতে পারে না। কিন্তু এ যুক্তি যথার্থ নয়, কেননা সাধারণ মানুষ অশিক্ষিত এ অপরাধ ও অপবাদে তাদের সরকার নির্বাচনের অধিকার থেকে বঞ্চিত করার অর্থ জনসাধারণকে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধিকার থেকে সরিয়ে রাখা।
তা ছাড়া রাজনৈতিক এবং পুঁথিগত শিক্ষা এক বিষয় নয়। পুঁথিগত বিদ্যা না থাকলেও যে মানুষ রাজনৈতিক জ্ঞানসম্পন্ন হতে পারে তার বহু উদাহরণ সকল সমাজেই বর্তমান। গণতন্ত্রে যে কোনো ব্যক্তি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারে, তাই যারা যোগ্যতাশালী তারা নির্বাচিত হয়। এতে অযোগ্য ব্যক্তি নির্বাচনের কোনো সম্ভাবনা থাকে না।
জ্ঞানী-গুণী বা প্রজ্ঞাবান ব্যক্তি নির্বাচনে জয়লাভ করতে পারে না এটা গণতন্ত্রের দোষ নয়, এটি তাদের নিজস্ব অযোগ্যতা। এর অপবাদ জনসাধারণের ঘাড়ে চাপানো যায় না। রাজনীতি একটি ভিন্ন ক্ষেত্র অতএব, এর জন্য আলাদা প্রশিক্ষণ আবশ্যক। জনসাধারণ হল রাজনীতির ক্ষেত্র, তাই রাজনীতি করার জন্য জনসাধারণের সাথে মেলামেশা করা দরকার।
এখান থেকে দূরে সরে থেকে ভোট প্রার্থনায় ব্যর্থ হলে তাকে গণতন্ত্রের দোষ হিসেবে চালিয়ে দেওয়া যাবে না। এটি ব্যক্তিগত অযোগ্যতা। এ ধরনের মন-মানসিকতার মাধ্যমে দেশে অভিজাত শ্রেণীর জন্ম নেয়। অভিজাত শ্রেণীর শাসন কার্যকর থাকলে গদিতে বসতে পারবে এজন্য অনেকে গণতন্ত্রের সমালোচনা করেছে। গণতন্ত্রকে ব্যয়বহুল সরকার বলা হয় কিন্তু তা ঠিক নয়।
রাজতন্ত্র বা অভিজাততন্ত্রে দু একজন সম্মানিত শাসকবর্গের জন্য যে অর্থ ব্যয় হয় তার পরিমাণ অনেক। গড়ে ৪/৫ বৎসর পর সরকার পরিবর্তন হয়, এতে সরকারের স্থায়িত্ব থাকে না তা যথার্থ নয় এবং নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য অর্থ ব্যয় হয় তা বলাও সমীচীন নয়। সরকার পরিচালনার ক্ষেত্রে বা অন্যবিধ যে ব্যয় হয় তা নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যয়ের চেয়ে বহুগুণ অধিক।
নির্বাচনে ব্যয় হবে এই ভয়ে জন রায় না নিয়ে অন্য কোনো প্রক্রিয়ায় সরকার গঠিত হতে পারে না। সরকার গঠনের একটিই উৎকৃষ্ট পদ্ধতি তা হল নির্বাচন। দলীয় প্রভাব, স্বজনপ্রীতি, ঘুষ, দুর্নীতি ইত্যাদির পরিমাণ অধিক বলে অভিযোগ করা হয়। গণতন্ত্রের জন্য দল আবশ্যক। দল ভিন্ন প্রতিনিধিত্বমূলক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চলতে পারে না।
দলের সিদ্ধান্ত ছাড়া সরকার গঠন না করলে অন্য কোনো প্রক্রিয়ায় সিদ্ধান্ত নেওয়া আবশ্যক হবে কিন্তু এতে দেশে স্বৈরশাসনের জন্ম দেবে। দলের প্রভাব থাকতে পারে, তবে এটি ব্যক্তিবিশেষের প্রতাপের চেয়ে অনেক বেশি মঙ্গলকর। ঘুষ-দুর্নীতির প্রভাব বেশি সে কথা বলা ঠিক নয়। গণতন্ত্রে অধিক সংখ্যক ব্যক্তির শাসন কার্যকর থাকে,
এতে ঘুষ প্রদানে এত পরিমাণ ব্যক্তিকে বশে আনা সম্ভব নয়। এটি রাজতন্ত্র বা একনায়কতন্ত্রে সম্ভব। এখান থেকে বলা যায় গণতন্ত্রের মধ্যে দুর্নীতির জন্ম নেওয়ার সম্ভাবনা কম, কেননা নাগরিকদের সম্মিলিত মতামতের মাধ্যমে সরকার গঠিত হয়। গণতন্ত্র হলো স্বৈরশাসনের থেকে অধিক ন্যায়সঙ্গত, সুতরাং গণতন্ত্র কার্যকরী হলে জনগণের নিরাপত্তা বিধান ও মানবিক মর্যাদার প্রতিষ্ঠা ঘটায়।
তাহলে দেখা যায় গণতন্ত্রের প্রতি সমালোচনা থাকা সত্ত্বেও বর্তমানকালে গণতন্ত্রই একটি আদর্শ শাসন ব্যবস্থা। এইভাবে গণতন্ত্রের সঠিক অর্থ এবং শাসন ব্যবস্থা কি তা বোঝা যায়।
গণতন্ত্র একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ শাসন ব্যবস্থা, যা আমাদের সকলের জীবনকে প্রভাবিত করে। এই পোস্টে আলোচনা করা বিষয়গুলো আপনাদের জন্য সহায়ক হয়েছে বলেই আশা করি। আরও নতুন এবং শিক্ষণীয় পোস্ট পড়ার জন্য দয়া করে আমার ওয়েবসাইট studytika.com-এ যান। সেখানে আরও অনেক আকর্ষণীয় বিষয় আপনার জন্য অপেক্ষা করছে।