ভাষা আন্দোলন এবং বাংলা ভাষার বিশ্বায়ন রচনা Class 7 8 9 10 ‍SSC HSC (২০+ পয়েন্ট)

ভাষা আন্দোলন এবং বাংলা ভাষার বিশ্বায়ন নিয়ে রচনা আজকের পোস্টে তুলে ধরা হয়েছে। এই রচনায় আপনি জানতে পারবেন এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর ওপর কিছু সহজ ও গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট।

ভাষা আন্দোলন এবং বাংলা ভাষার বিশ্বায়ন রচনা Class 7 8 9 10 ‍SSC HSC (২০+ পয়েন্ট)

ভাষা আন্দোলন এবং বাংলা ভাষার বিশ্বায়ন রচনা

ভূমিকা : পাকিস্তান সৃষ্টির শুরু থেকেই পাকিস্তানের জাতীয় নেতৃত্ব সাংস্কৃতিক মিশ্রণের এক কেন্দ্রীভূত নীতি গ্রহণ করে। এ নীতির চাপ অধিকমাত্রায় অনুভূত হয় পশ্চিম পাকিস্তানের চেয়ে পূর্ব বাংলায় তথা পূর্ব পাকিস্তানে। শুধু সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেই নয়, জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রেও কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব বিমাতাসুলভ আচরণ শুরু করে। এতে পূর্ব পাকিস্তানের যুব সম্প্রদায়, বুদ্ধিজীবী এবং সর্বোপরি আপামর জনসাধারণের মধ্যে চরম হতাশার সৃষ্টি হয়, সৃষ্টি হয় এক চাপা অসন্তোষের। আর এ হতাশা ও অসন্তোষের তীব্র ও ব্যাপক প্রসার ঘটে ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে। মূলত দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ধর্মীয় কারণে প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তান ইসলামী রাষ্ট্র হলেও এর সমাজ ব্যবস্থায় একক আদর্শগত কোনো যোগসূত্র ছিল না। এর কারণ পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যকার ভাষাগত বিরোধ। এ কারণে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ পাকিস্তানের মৌলিক আদর্শের সাথে কোনোদিন একাত্মতা অনুভব করতে পারেনি। আর এ কারণেই পাকিস্তান সৃষ্টির অব্যবহিত পরেই ১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে পূর্ব বাংলায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ অধ্যাপক আবুল কাসেমের নেতৃত্বে ‘তমদ্দুন মজলিস’ নামক সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের মাধ্যমে ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে। এ আন্দোলনের প্রভাব বাংলার সুদীর্ঘ রাজনৈতিক ইতিহাসের পরতে পরতে দেখতে পাওয়া যায় এবং যার সার্থক পরিণতি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। 

ভাষা আন্দোলনের ঐতিহাসিক পটভূমি : বাংলার জাতীয় ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় ঘটনার সূচনা হয় পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরপরই, যখন নিখিল পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মাতৃভাষা বাংলা হওয়া সত্ত্বেও সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিকভাবে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হয়। এর ফলস্বরূপ, ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান স্বাধীন হওয়ার মাত্র ১৭ দিনের মাথায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ অধ্যাপক আবুল কাসেমের নেতৃত্বে ১ সেপ্টেম্বর ৩ সদস্যবিশিষ্ট তমদ্দুন মজলিস গঠিত হয়। সংগঠনের সহযোগী সদস্যদের মধ্যে ছিলেন দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ, অধ্যাপক এ এস এম নূরুল হক ভুঁইয়া, শাহেদ আলী, আবদুল গফুর, বদরুদ্দীন ওমর প্রমুখ। সংগঠনটি জন্মলগ্ন থেকেই বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি উত্থাপন করে, কিন্তু পাকিস্তানের শাসকগণ এই দাবি মেনে নিতে রাজি ছিলেন না। প্রকৃতপক্ষে, পূর্ব পাকিস্তানে ভাষা আন্দোলনের সূচনা হয় পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর একতরফা ভাষা সিদ্ধান্ত এবং সেই সিদ্ধান্তকে জোরপূর্বক বাঙালিদের ওপর চাপিয়ে দেয়ার প্রচেষ্টার মাধ্যমে। পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণ করতে চেয়েছিল, যদিও বাস্তবে উর্দু ভাষাভাষী মানুষের সংখ্যা ছিল অনেক কম।

ভাষা আন্দোলনের প্রথম পর্যায় : ১৯৪৭ সালের নভেম্বর মাসে করাচিতে এক কেন্দ্রীয় পর্যায়ের শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার সিদ্ধান্ত হয়। ফলে পূর্ব বাংলায় এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড প্রতিবাদ শুরু হয়। ১৯৪৮ সালের জানুয়ারি মাসে এ সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে ঢাকায় সর্বপ্রথম রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয় এবং কতিপয় দাবিতে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের নীতি গৃহীত হয়। 

ভাষা আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্যায় : ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদের প্রথম অধিবেশনে কংগ্রেস দলীয় সদস্যগণ বিশেষত কুমিল্লার ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত দাবি জানান ইংরেজি ও উর্দুর পাশাপাশি বাংলা ভাষা ব্যবহার করার জন্য। গণপরিষদের কংগ্রেস সদস্যগণও বাংলা ও উর্দুর সমান মর্যাদা দাবি করেন। পরবর্তীতে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ এবং পূর্ব পাকিস্তানের মুসলিম ছাত্রলীগের মধ্যে এক আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু এ আলোচনা মোটেই ফলপ্রসূ হয়নি। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব বাংলা ভাষার দাবিকে বিনষ্ট করার জন্য দমনমূলক নীতির আশ্রয় গ্রহণ করে এবং ভাষা আন্দোলনের সমর্থকদের জেলে আটক করা হয়। ফলে চারদিকে প্রতিবাদের ঝড় উত্থিত হয় এবং আন্দোলনের পথ প্রশস্ত হয়। ছাত্র নেতৃবৃন্দ এবং জনগণ সম্মিলিতভাবে আটককৃত ছাত্রদের মুক্তির দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট আহ্বান করে। এর ফলে দেশের সর্বত্রই বাংলা ভাষার দাবি জোরালো আকার ধারণ করে। এতে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী আরও দমনমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে উদ্যত হন। 

ভাষা আন্দোলনের শেষ পর্যায় : 

ক. রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি : উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণার প্রতিবাদে রাষ্ট্রভাষা বাংলার আন্দোলনকে আরও তীব্রতর করার লক্ষ্যে ১৯৫২ সালের ৩০ জানুয়ারি এক জনসভায় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়। এ কমিটিতে আওয়ামী লীগ থেকে ২ জন, পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগ থেকে ২ জন, খিলাফতই রব্বানী থেকে ২ জন, ছাত্রলীগ থেকে ২ জন এবং বিশ্ববিদ্যালয় কমিটি থেকে ২ জন সদস্য গৃহীত হয়। আহ্বায়ক ছিলেন গোলাম মাহবুব। এ কমিটি ২১ ফেব্রুয়ারিকে ভাষা দিবস হিসেবে পালন করার এবং দেশব্যাপী হরতাল পালনের সিদ্ধান্ত নেয়। 

খ. ঐতিহাসিক মিছিল এবং ১৪৪ ধারা ভঙ্গ : ২১ ফেব্রুয়ারির উক্ত কর্মসূচিকে বানচাল করার জন্য তৎকালীন গভর্নর নুরুল আমীন সরকার ঢাকায় ১৪৪ ধারা জারি করেন। কিন্তু পূর্ব বাংলার ছাত্র-জনতা এতে ভয় পায়নি। তারা এতে কোনোরূপ ভ্রুক্ষেপ না করে সংগ্রাম চালিয়ে যায়। সরকার কর্তৃক জারিকৃত ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে শান্তিপূর্ণ মিছিল বের করে তৎকালীন প্রাদেশিক ভবনে গিয়ে তাদের দাবি মায়ের ভাষা, বাংলা ভাষার দাবি উত্থাপন করবে বলে স্থির করে। নির্ধারিত সময়সূচি অনুসারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরাতন কলা ভবনের সামনে থেকে মিছিল অগ্রসর হয় এবং কিছুদূর অগ্রসর হয়ে মিছিল যখন ঢাকা মেডিকেল কলেজের সামনে আসে ঠিক তখনই সে মিছিলের উপর পুলিশ গুলিবর্ষণ করে। ফলে মিছিল কিছুটা ছত্রভঙ্গ হয় এবং কয়েকজন তরুণ ঘটনাস্থলেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। রফিক, বরকত, সালাম, জব্বারসহ আরও নাম না জানা অনেক ছাত্র মৃত্যুবরণ করেন। সরকারের এ বর্বরোচিত হামলার প্রতিবাদে সারাদেশে বিদ্রোহের আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে। ছাত্রদের পাশাপাশি সমাজের সর্বস্তরের মানুষ প্রতিবাদমুখর হয়ে শহীদানের রক্তে রঞ্জিত রাজপথে নেমে আসেন এবং এক প্রবল অপ্রতিরোধ্য আন্দোলন গড়ে ওঠে। 

গ. রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা ভাষার স্বীকৃতি লাভ : অবশেষে এদেশের আপামর জনসাধারণের প্রবল বিক্ষোভের মুখে সরকার নতি স্বীকার করতে বাধ্য হয় এবং সাময়িকভাবে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার একটি প্রস্তাব প্রাদেশিক পরিষদে উত্থাপন করা হয়। প্রস্তাবটি সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। অতঃপর ১৯৫৬ সালের সংবিধানের ২১৪(১)নং অনুচ্ছেদে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মর্যাদা দিলে বাঙালি জাতির বিজয় অর্জিত হয়। 

ভাষা আন্দোলন এবং বাংলা ভাষার বিশ্বায়ন : ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি এদেশের আপামর ছাত্র সমাজের বুকের তাজা রক্তের বিনিময়ে যে মাতৃভাষা বাংলা অর্জিত হয়েছে তার গণ্ডি এখন শুধু দেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। বরং একুশে ফেব্রুয়ারি এবং ভাষা আন্দোলনের চেতনা আজ ছড়িয়ে পড়েছে সর্বতত্র। ভাষার জন্য বাঙালি জাতির এ আত্মত্যাগ আজ নতুন করে বিশ্বকে ভাবতে শিখিয়েছে মাতৃভাষার গুরুত্ব সম্পর্কে। ১৭ নভেম্বর ১৯৯৯ জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান এবং সাংস্কৃতিক সংস্থা (UNESCO) সাধারণ পরিষদে আমাদের জাতীয় চেতনার ধারক একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। বিশ্বের প্রতিটি প্রান্তের মানুষ আজ বাঙালিদের মাতৃভাষার জন্য আত্মত্যাগের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করেছে। সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত বাংলা ভাষা আজ যে বৈশ্বিক মর্যাদা লাভ করেছে তা মূলত আমাদের জাতীয় চেতনাবোধের বিজয়। ইউনেস্কোর গ্রহীত প্রস্তাবে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালনের প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করে বলা হয় যে, ‘সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণে ভাষা সবচেয়ে শক্তিশালী হাতিয়ার। মাতৃভাষার প্রচলন কেবল ভাষাগত বৈচিত্র্য এবং বহু ভাষাভিত্তিক শিক্ষাকেই উৎসাহিত করবে না, তা ভাষাগত এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের উন্নয়ন অনুধাবনের ক্ষেত্রে সহায়তা করবে।’ বাংলাদেশসহ জাতিসংঘভুক্ত ১৯৩টি দেশ বর্তমানে একুশে ফেব্রুয়ারিকে পালন করছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে। বাংলা ভাষা ও বাঙালির জন্য এ প্রাপ্তি সহস্র মর্যাদার প্রতীক। 

উপসংহার : উপযুক্ত আলোচনার মাধ্যমে এ কথা স্পস্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, পাকিস্তান সৃষ্টির সূচনার পর থেকেই পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী পূর্ব পাকিস্তানকে তাদের উপনিবেশ হিসেবে গড়ে তুলতে সচেষ্ট হন। সে উদ্দেশ্যকে বাস্তবায়ন করার লক্ষ্যে তারা প্রথমে বাংলা ভাষার ওপর আঘাত হানে। আর ১৯৫২ সালে রাষ্ট্রভাষার প্রশ্ন নিয়ে বাঙালি জাতি সর্বপ্রথম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ সংগ্রামে লিপ্ত হয়। ভাষা আন্দোলনের সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ হয়েই বাঙালি জাতি পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর প্রতিটি ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে দিতে সক্ষম হয়। ১৯৫২ সাল থেকে শুরু করে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রতিটি স্তরে প্রেরণা যুগিয়েছে ভাষা আন্দোলনের রক্তরাঙা ইতিহাস। ভাষার জন্য বাংলামায়ের সন্তানদের আত্মত্যাগ দেশের গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে ঘোষিত হওয়ার পর বিশ্বের প্রতিটি প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছে বাঙালি ও বাংলা ভাষার গৌরব। বর্তমানে বিশ্বের প্রায় ৩০ কোটি লোক বাংলা ভাষায় কথা বলে। এ শুধু বাংলা ভাষার বিশ্বায়নই নয়, বরং বাঙালি জাতির বিজয়। আমাদের শহীদদের আত্মত্যাগের ফলেই আজ আমরা গর্ব করতে পারি। ভাষা আন্দোলনের আদর্শকে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে বাস্তবায়িত করতে পারলেই বায়ান্নর শহীদদের আত্মদান সার্থক হবে।

Conclusion: আরও রচনা পড়তে, দয়া করে আমার ওয়েবসাইটটি ভিজিট করুন। StudyTika.com-এ আরও অনেক রচনা রয়েছে যা আপনাকে সাহায্য করবে!

Getting Info...

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Oops!
It seems there is something wrong with your internet connection. Please connect to the internet and start browsing again.