ইতিহাস পাঠের প্রয়োজনীয়তা রচনা Class 7 8 9 10 ‍SSC HSC (২০+ পয়েন্ট)

 প্রস্তাবনা: ইতিহাস আমাদের অতীতের গল্প শোনায়, যা আমাদের বর্তমান এবং ভবিষ্যত গঠনে সহায়তা করে। “ইতিহাস পাঠের প্রয়োজনীয়তা” বিষয়ক এই রচনাটি আপনাদের জন্য খুবই উপকারী হবে। চলুন, এই রচনার মাধ্যমে আমরা জানবো কেন ইতিহাস জানা আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

ইতিহাস পাঠের প্রয়োজনীয়তা রচনা Class 7 8 9 10 ‍SSC HSC (২০+ পয়েন্ট)

ইতিহাস পাঠের প্রয়োজনীয়তা রচনা 

ভূমিকা :

‘স্তব্ধ অতীত, হে গোপনচারী, অচেতন তুমি নও-
কথা কেন নাহি কও।’
-রবীন্দ্রনাথ

ইতিহাস স্তব্ধ অতীন নয়। ইতিহাস চির-মুখর। যুগ-যুগান্তর ধরে মানব-সভ্যতার চলমান জীবনধারাই ইতিহাস। সেই চক্রতীর্থের পথে পথে ছড়িয়ে আছে কত শত ভাঙা-গড়ার ইতিহাসের অর্ধলুপ্ত অবশেষ। কত রক্ত-রঞ্জিত দৃশ্যপটের পরিবর্তন। কত নিশীথকালে দুঃস্বপ্ন-কাহিনী। কত উত্থান-পতন, কত চেষ্টার তরঙ্গ, কত সামাজিক বিবর্তন। আজ যা বর্তমান, কালই তা অতীত। ইতিহাস ত্রি-কাল-সূত্রে গ্রথিত। ইতিহাস তো অতীতেরই সত্য-স্বরূপ উদ্ঘাটন, এক অনন্ত মানব-জীবন প্রবাহের অনির্বাণ দীপ-শিখা। ইতিহাস অতীতের অভিজ্ঞতা, বর্তমানের সাধনা, ভবিষ্যতের ইঙ্গিত। ইতিহাস পাঠের মাধ্যমে আমরা মানবসমাজের শুরু থেকে তার যাবতীয় কর্মকাণ্ড, চিন্তা-চেতনা ও জীবনযাত্রার অগ্রগতি সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করতে পারি। ইতিহাসকে মানব জাতির দর্পণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। 

ইতিহাসের সংজ্ঞা :

ঘটনার নিরন্তর সত্যানুসন্ধানই হচ্ছে ইতিহাস। একবিংশ শতাব্দীর সন্ধিক্ষণে মানবজাতি আজ সভ্যতার স্বর্ণশিখরে পদার্পণ করেছে। কিন্তু চিরঅনুসন্ধিৎসু আজকের মানুষ জানতে চায় তার পূর্ববর্তী সহস্র বছরের ইতিকথা, ঘটনা প্রবাহ। বস্তুত মানবহৃদয়ের চিরন্তন এ কৌতূহলের জবাবই ইতিহাস। 

ইতিহাসের মূল বাণীই হর চলমানতা। শুধু অতীতের স্তূপীকৃত ঘটনার আদ্যন্ত বিবরণই ইতিহাস নয়। সন-তারিখ-কণ্টকিত খণ্ড-বিচ্ছিন্ন রাজা বা রাজ্যের ভাঙা গড়ার তথা বিবৃতিও ইতিহাস নয়; নয় রাজা-মহারাজার জন্ম-মৃত্যুর নিছক তথ্য উদ্ঘাটন। ইতিহাস মানুষের ধারাবাহিক জীবন-প্রবাহ। যুগ-যুগান্তরব্যাপী অসংখ্য মানুষের ক্রম-বিবর্তনের চলচ্চিত্রই ইতিহাস। সভ্যতার যে ঊষাকাল থেকে মানুষের যাত্রা শুরু হয়েছিল এবং সেই যাত্রাপথে সমাজ সংস্কৃতি রাজনীতি অর্থনীতির যে ক্রম-পরিণতি, যা বর্তমানে প্রসারিত, ভবিষ্যতের পথ-নির্দেশ এবং যে চলার কেবলই নব নব উত্তরণ, তাই হলো মানুষের ধারাবাহিক ইতিহাস। ইতিহাসের মধ্যেই রয়েছে মানুষের স্বপ্ন, সাধনা এবং সিদ্ধি। ইতিহাসের কাছেই মানুষের মহাদীক্ষা। ইতিহাসই মানুষের এক মহৎ উত্তরাধিকার। মেইটল্যান্ডের ভাষায়:
'What men have done and said, and above all, what they have thought that is history.' 

ইতিহাস স্থান ও কালের পরিপ্রেক্ষিতে সমাজবদ্ধ মানব-প্রকৃতির বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ। ইতিহাসকে নিয়ে কত ইতিহাসবিদ্ কতভাবে যে সংজ্ঞায়িত করেছেন তার কোনো ইয়ত্তা নেই, উনিশ শতকে জার্মান ঐতিহাসিক লিওপোল্ড ফন্ র‌্যাংকে বলেন, 

‘প্রকৃতপক্ষে যা ঘটেছিল তার অনুসন্ধান ও বিবরণই ইতিহাস।’ 

র‌্যাপসনের মতে,

‘ইতিহাস হল ঘটনার বৈজ্ঞানিক এবং ধারাবাহিক বিবরণ।’ 

ই.এইচ.কার-এর মতে,

‘ইতিহাস হল বর্তমান ও অতীতের মধ্যে অন্তহীন সংলাপ’

চলতি অর্থে 

ইতিহাস হচ্ছে মানব কর্মকাণ্ড, সমাজ ও পারিপার্শ্বিকতা সম্পর্কিত বিশ্লেষণাত্মক লিখিত বিবরণ। 

ইতিহাসের বিষয়বস্তু :

ইতিহাসের মূল বিষয় হচ্ছে মানুষ ও তার সমাজ। মানুষ ও সমাজকে কেন্দ্র করে সমাজ ও সভ্যতার ক্রমবিকাশ, পরিবর্তন ও পতনের ধারাবাহিক ঘটনাবলিই ইতিহাসের মূল বিষয়বস্তু। তবে ঘটে যাওয়া সকল কর্মকান্ডই ইতিহাসে স্থান পায় না বরং যে সব ঘটনা বা বিষয় তাৎপর্যপূর্ণ ও গ্রহণযোগ্য বা বিজ্ঞানভিত্তিক বলে মনে হয়, তা-ই ইতিহাস। ইতিহাসের বিষয়বস্তুসমূহ নিম্নরূপ: 

১। মানুষ, সমাজ ও তার পারিপার্শ্বিকতা :

ইতিহাসের অন্যতম বিষয়বস্তু হল মানবজীবনের বিকাশের ধারাবিবরণী, অর্থাৎ মানবসমাজের বিবর্তনপ্রক্রিয়া ইতিহাসের একটি অন্যতম বিষয়বস্তু হিসেবে বিবেচিত। 

২। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড :

জীবনযাপনের মূল ভিত্তি হলো খাদ্য। সময়ের সাথে মানুষের প্রকৃতির ওপর নিয়ন্ত্রণ বেড়ে যায়, ফলে খাদ্যের নির্বাচন ও উৎপাদনে তারা অনেক এগিয়ে যায় এবং সফল হয়। অর্থনৈতিক উন্নতির মাধ্যমে মানুষ উদ্বৃত্ত উৎপাদন করতে পারে এবং সেই সঙ্গে গড়ে তোলে গ্রাম, এরপর নগর, তারপর রাজ্য এবং অবশেষে সাম্রাজ্য। মানুষের এই অগ্রগতি, তার সফলতা ও ব্যর্থতা—সবকিছুই ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা বিষয়।

৩। রাজনৈতিক ও সামাজিক কর্মকাণ্ড :

রাষ্ট্রের শাসন প্রক্রিয়া, শাসন কাঠামোর ধারাবাহিক উন্নতি, অবনতি সর্বোপরি রাজনৈতিক ও সামাজিক কর্মকাণ্ডের বিবর্তন ইতিহাসের অন্যতম প্রধান বিষয়বস্তু।

৪। সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড :

সমাজে মানুষের দৈনন্দিন আচার-ব্যবহার, রীতি-নীতিই হচ্ছে তার সংস্কৃতি। ইতিহাস একটি জাতির ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধকে যথাযথভাবে সংরক্ষণ করে। সুতরাং শিক্ষা-সংস্কৃতি ইতিহাসের মূল বিষয়বস্তু হিসেবে পরিগণিত।

ইতিহাস-পাঠের প্রয়োজনীয়তা :

একটি দেশের প্রতিটি সুনাগরিক তথা সচেতন লোক মাত্রই ইতিহাস পাঠের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। নিচে ইতিহাস পাঠের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি বিষয় উপস্থাপন করা হল- 

১। মানবসভ্যতা ও সভ্যতার বিকাশ সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করা :

ইতিহাস পাঠের মাধ্যমে মানুষ সমাজের শুরু থেকে তার যাবতীয় কর্মকাণ্ড চিন্তা-চেতনা ও জীবনযাত্রার অগ্রগতি সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান লাভ করতে পারে। কেননা ইতিহাসের প্রধান উপজীব্য বিষয় হয় মানবসমাজের অগ্রগতির ধারা বর্ণনা করা। 

২। জ্ঞানার্জনের ক্ষেত্রে :

ইতিহাস আমাদের অতীত সম্পর্কে জানিয়ে দিয়ে বর্তমানের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের উন্নয়নের ক্ষেত্রে সহায়তা করে বলে, সঠিক শিক্ষা ও দিকনির্দেশনার জন্য ইতিহাস পাঠের প্রয়েঅজনীয়তা রয়েছে। 

৩। জাতীয় চেতনার বিকাশ :

একটি জাতির ঐতিহ্য ও গৌরবময় অতীত তার বর্তমান কর্মযজ্ঞকে উৎসাহিত করে, এজন্য জাতীয় চেতনা জাগ্রত করতে ইতিহাস পড়ার বিকল্প নেই। তাই আজকের সময়ে আত্মপরিচয়ের সংকটে ইতিহাস অধ্যয়ন আমাদের জাতীয় কর্তব্য।

৪। জাতীয় পরিচয় :

যে কোনো জাতীয় জাতিয় ইতিহাস ও ঐতিহ্যের উপর ভিত্তি করে জাতীয়তাবোধ গড়ে ওঠে যা দেশ ও সমাজের উন্নতি তথা দেশপ্রেমের জন্য একান্ত অপরিহার্য। তাই জাতীয় পরিচয়ের ক্ষেত্রে ইতিহাস পাঠের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। 

৫। বর্তমান ও ভবিষ্যতের কর্মপন্থা নির্ধারণে :

বর্তমানে ঐতিহাসিক ঘটনার সঠিক আলোচনার ফলে ইতিহাস বন্ধনমুক্ত ও সকল সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে। আর এ মুক্ত ইতিহাস আমাদের অতীত সময়ের অবস্থা সম্পর্কে সঠিক ধারণা প্রদান করে এবং বর্তমান ও ভবিষ্যতের কর্মপন্থা নির্ধারণে সাহায্য করে। 

৬। জাতির ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির মূল্যকে সংরক্ষণ করে :

ইতিহাস একটি জাতির ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতিক মূল্যকে যথাযথভাবে সংরক্ষণ করে। সমাজ ও জাতির অগ্রগতির কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছুতে ইতিহাস জ্ঞান সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করে। একই সাথে ইতিহাস জ্ঞান আমারদের গর্বিত করে তুলতে পারে অতীত ঐতিহ্যের প্রতি। এর ফলে আমরা উদ্দীপিত হতে পারি জাতীয় ইতিহাস ও ঐতিহ্যেকে সমুন্নত রাখার একান্ত প্রত্যাশায়। 

ইতিহাস রচনার বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি :

ইতিহাস যেখানে জাতির পথ-প্রদর্শক, সেখানে ইতিহাস রচনার গুরুত্ব ও দায়িত্ব অনেক বেশি। অতীতের ভুল-ভ্রান্তি ইতিহাসের মাধ্যমেই সংশোধন করে নেয় মানুষ। সংগ্রহ করে আগামী দিনের চলার পাথেয়। ইতিহাসবিহীন জাতি বিশাল তরঙ্গক্ষুব্ধ সমুদ্রে হালহীন নাবিকের মতোই অসহায়, শঙ্কিত-হৃদয়। শাশ্বত সত্য সন্ধানই ইতিহাসের লক্ষ্য। যথার্থই, যে জাতির ইতিহাস নেই তার বর্তমান খন্ডিত, ভবিষ্যৎ কুয়াশাচ্ছন্ন, সম্ভাবনাহীন। ইতিহাসকে হতে হবে তথ্যনির্ভর, যুক্তিনিষ্ঠ। ক্ষুরধার বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণেই ইতিহাসের শাণিত দীপ্তি। সত্যের ছদ্মবেশে মিথ্যার বিভ্রান্তি সৃষ্টি, ইতিহাস রচনার পরিপন্থি। বাস্তব ঘটনাবলিকে নিজের মনের রঙে রঞ্জিত না করে যথাযথ উপস্থিত করাই ঐতিহাসিকের কাজ। তাই ঐতিহাসিকের দায়িত্ব অসীম। মানুষের ভাঙা-গড়া, সুখ-দুঃখের জীবনে, জাতীয় দুর্গতি ও দুর্গতি-মোচনে, পরাধীনতার দাসত্বে ও মুক্তিতে কোন্ মহা-শক্তির অঙ্গুলি নির্দেশ, ঐতিহাসিককে সেই সত্যটিই উদ্ঘাটিত করতে হবে। ইতিহাসের মধ্যেই নিহিত থাকে জাতির ভাব-সম্পদ। অথচ যে ভাব-সম্পদে ছিল একদা সমৃদ্ধ, সেই যথার্থ ইতিহাস নেই। আমরা যে ইতিহাস পড়ি তা বিদেশির রচিত ইতিহাস। ফলে, আমরা প্রকৃত ইতিহাস জানতে পারছি না। ঐতিহাসিকের দায়িত্ব মৃত্তিকায় বিচিত্র জীবনস্রোতে মানব মহিমার যে প্রচুর উপাদান বিক্ষিপ্তভাবে ছড়ানো রয়েছে, তার উদ্ধার করে যথার্থ জাতীয় ইতিহাস প্রণয়ন। 

উপসংহার :

ইতিহাস শুধু ছাত্রজীবনেই নয়, যেকোনো শিক্ষিত মানুষেরই ইতিহাস আবশ্যপাঠ্য বিষয়। যুগে যুগে পৃথিবীর বুকে মানুষ যে সন্দরের স্বপ্ন দেখেছে এবং সেই স্বপ্নকে সার্থক করার যে নিরলস কর্মপ্রয়াস, ইতিহাস তারই ধারাবাহিক বিবরণ। মানুষের যা ছিল সুন্দর, মহৎ এবং শাশ্বত ইতিহাস তারই সঞ্চয়। সেই সঞ্চিত ঐশ্বর্যেই মানব-সভ্যতার মহিমা। আর যা অর্থহীন, মৃত, পরিকীর্ণ কঙ্কালস্তূপ, জীবন-বিকাশের পরিপন্থী, তা কালস্রোতে ভেসে গেছে। ভেসে যায়। সবশেষে বলা যায়, ইতিহাস রচনা ও চর্চা সম্পর্কে বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থাকতে পারে, কিন্তু ইতিহাসের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে কোনো দ্বিমত নেই। রাষ্ট্রনায়ক বুদ্ধিজীবী, সামরিক ব্যক্তিবর্গ ও প্রশাসকসহ সমাজের সর্বস্তরের মানুষের কাছে ইতিহাস খুবই মূল্যবান বিষয়।

এই রচনার মাধ্যমে ইতিহাস পাঠের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে অনেক কিছু জানলেন। আরও অনেক রচনা পড়তে চাইলে, দয়া করে আমার ওয়েবসাইট StudyTika.com ভিজিট করুন।

Getting Info...

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Oops!
It seems there is something wrong with your internet connection. Please connect to the internet and start browsing again.