বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তন রচনা Class 7 8 9 10 ‍SSC HSC (২০+ পয়েন্ট)

এই ব্লগপোস্টে রয়েছে “বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তন” বিষয়ক একটি সহজ ও সুন্দর রচনা। রচনাটি একবার পড়লে আপনি সম্পূর্ণ বুঝতে পারবেন। চলুন, পড়ে নিই।

বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তন রচনা Class 7 8 9 10 ‍SSC HSC (২০+ পয়েন্ট)

 বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তন রচনা ১

ভূমিকা : জলবায়ু পরিবর্তন বর্তমান বিশ্বের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে উপনীত হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে বড় কারণ বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি- যার ফলে আবহাওয়া পরিবর্তিত হয়েছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়েছে এবং বিশ্ব নিয়মিত প্রাকৃতিক দুর্যোগের সম্মুখীন হচ্ছে। বৈশ্বিক উষ্ণতা বেড়ে যাওয়ার কারণ বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা বৃদ্ধি এবং এই তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার প্রধান কারণ গ্রিন হাউজ ইফেক্ট। সূর্য থেকে আগত তাপশক্তি পৃথিবীপৃষ্ঠকে উত্তপ্ত করে এবং এ বিকিরিত তাপশক্তির অধিকাংশই পুনরায় বায়ুমণ্ডলে ফিরে যায়। কিন্তু মানবসৃষ্ট দূষণ এবং বনভূমি উজাড় করার ফলে বায়ুমণ্ডলে গ্রিন হাউস গ্যাসের পরিমাণ আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে গেছে, যা কার্বন ডাই-অক্সাইড, মিথেন ও নাইট্রাস অক্সাইডের সমন্বয়ে গঠিত। এর ফলে বিকিরিত তাপশক্তি পুনরায় বায়ুমণ্ডলে ফিরে যাওয়ার পথে বাধাপ্রাপ্ত হয় এবং এভাবেই বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায়। আধুনিককালে ব্যাপক হারে জীবাশ্ম জ্বালানি দহন, বনাঞ্চল ধ্বংস, শিল্পায়নের ফলে গ্রিন হাউজ ইফেক্টের মাত্রা অনেক বেশি বেড়ে গেছে। এর ফলে ১৮৫০-১৯৬০ সালের মধ্যে পৃথিবীর তাপমাত্রা প্রায় পাঁচগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এই অতিরিক্ত তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে বর্তমান বিশ্ব প্রতিনিয়ত বিভিন্ন পরিবেশগত বিপর্যয়ের সম্মুখীন হচ্ছে। পরিবেশ বিপর্যয়ের ফলে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম।

বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণ : পৃথিবীকে ঘিরে থাকা বায়ুমণ্ডলের জন্যই এখানে প্রাণ ধারণ ও বসবাস সম্ভব হয়েছে। বায়ুমণ্ডলের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো ‘ওজোন স্তর’, যা সূর্যের ক্ষতিকর অতিবেগুনি রশ্মি পৃথিবীতে প্রবেশে বাধা দেয় এবং পৃথিবী থেকে তাপ আবার মহাশূন্যে ফিরে যেতে সাহায্য করে। কিন্তু মানুষের তৈরি দূষণ ও বন ধ্বংসের কারণে এই ওজোন স্তর দিন দিন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ফ্রিজ, এয়ারকন্ডিশনার, স্প্রে প্রভৃতি গৃহস্থালি ও শিল্প পণ্যে ব্যবহৃত ক্লোরোফ্লোরো কার্বন (CFC) গ্যাস ওজোন স্তর ধ্বংসের একটি প্রধান কারণ। পাশাপাশি, কলকারখানা, যানবাহন, ও বিভিন্ন বর্জ্য থেকে নির্গত কার্বন ডাই-অক্সাইড, নাইট্রাস অক্সাইড ও মিথেন গ্যাস বায়ুমণ্ডলে তাপ আটকে রাখছে। বনভূমি উজাড় হওয়ায় অতিরিক্ত কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণও সম্ভব হচ্ছে না। ফলে একদিকে সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মি বেশি পরিমাণে পৃথিবীতে পৌঁছাচ্ছে, অন্যদিকে বাতাসে তাপ জমে যাচ্ছে। এতে করে পৃথিবীর তাপমাত্রা ক্রমেই বাড়ছে এবং পরিবেশ মারাত্মক হুমকির মুখে পড়েছে।

বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি ও বাংলাদেশে এর প্রভাব : পরিবেশ বিজ্ঞানীদের মতে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশে যেসব বড় ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা দিচ্ছে তা মূলত জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেই দেখা দিচ্ছে। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধিই মূলত এ পরিবর্তিত জলবায়ুর জন্য দায়ী। বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে বাংলাদেশের সম্ভাব্য ভয়াবহ পরিণতিসমূহ আলোচনা করা হলো :

১. সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি : বিশ্ব উষ্ণায়নের একটি সম্ভাব্য পরিণতি হলো সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি। বায়ুমণ্ডলে তাপমাত্রা বৃদ্ধি ফেলে ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাবে। এর ফলে সমুদ্রের পানির উত্তাপ বৃদ্ধি পাবে এবং পানি সম্প্রসারিত হলে সমুদ্রের আয়তন ও পরিধিকে বাড়িয়ে তুলবে। উষ্ণায়নের ফলে হিমালয়সহ অন্যান্য পর্বতচূড়ায় জমে থাকা বরফ গলে যাবে এবং সমুদ্রের পানির উচ্চতা বেড়ে যাবে। এর ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির সাথে সাথে প্লাবিত এলাকার পরিমাণও বেড়ে যাবে। উত্তর ও দক্ষিণমেরুর গ্রীনল্যান্ড, অ্যান্টার্কটিকাসহ অন্যান্য ভূ-ভাগের বরফ গলে যাবে, যা সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা আশঙ্কাজনকভাবে বাড়িয়ে তুলবে। এভাবে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাবে।

বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম বড় ব-দ্বীপ, যেখানে অনেক নদ-নদী রয়েছে। যদি পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে যায়, তাহলে বাংলাদেশের প্রায় ১৯ শতাংশ জমি সাগরে ডুবে যাবে এবং এতে প্রভাবিত হবে প্রায় ৫৫ মিলিয়ন মানুষ। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রতি বছর সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ৭ মিমি হারে বাড়ছে, কিন্তু ভূপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে বছরে মাত্র ৫-৬ মিমি। ফলে উপকূলীয় অঞ্চলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ১-২ মিমি করে বাড়ছে। Intergovernmental Panel of Climate Change (IPCC)-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই হারে চলতে থাকলে প্রতি দশকে সমুদ্রপৃষ্ঠ ৩.৫ থেকে ১৫ মিমি পর্যন্ত বাড়তে পারে, আর ২১০০ সালের মধ্যে তা ৩০ সেন্টিমিটার থেকে ১ মিটার পর্যন্ত উঠতে পারে। এভাবে সমুদ্রপৃষ্ঠের এই বাড়তি উচ্চতা বাংলাদেশের জন্য এক ভয়াবহ পরিবেশগত বিপদ ডেকে আনতে পারে।

২. মরুভূমির বৈশিষ্ট্য : বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে একদিকে যেমন পৃথিবীর নিচু এলাকাসমূহ সমুদ্র গর্ভে বিলীন হয়ে যাবে তেমনি পৃথিবীর বিভিন্ন অংশে মরুভূমির বৈশিষ্ট্য দেখা দেবে। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি পাওয়ার সাথে সাথে ভূ-পৃষ্ঠে পানির পরিমাণ ক্রমাগত হ্রাস পাবে। ফলে সমগ্র ভূমি মরুভূমিতে পরিণত হবে। এর ফলে কৃষিকাজ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং জীববৈচিত্র্য হুমকির সম্মুখীন হবে। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে ইতোমধ্যে মরুভূমির বৈশিষ্ট্য দেখা দিয়েছে। এর ফলে খাদ্য উৎপাদন ব্যাহতসহ তা দেশের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

৩. নিম্নভূমিতে প্লাবন : বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে বাংলাদেশসহ পৃথিবীর অন্যান্য নিম্নভূমি সমুদ্রগর্ভে বিলীন হয়ে যাবে। বায়ুমণ্ডলে তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার ফলে অ্যান্টার্কটিকার বরফ গলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যাবে এবং উপকূলীয় এলাকাসমূহ ক্রমেই নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে বাংলাদেশের প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার বর্গ কিমি এলাকা প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হবে। পরিবেশবিজ্ঞানীদের মতে, বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির এ ধারা অব্যাহত থাকলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা এই শতাব্দীর শেষ দিকে ২০-৬০ সেমি পর্যন্ত বাড়তে পারে। জলবায়ু পরিবর্তিত হলে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বেড়ে যাবে এবং নদ-নদীর পানির পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে। আমাদের দেশের অধিকাংশ নদীর উৎস দেশের বাইরে ভারত ও নেপালে। তাই একদিকে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি ও অপরদিকে ব্যাক ওয়াটার ইফেক্ট যুক্ত হয়ে ভয়াবহ বন্যার সৃষ্টি করবে।

৪. জীববৈচিত্র্য ধ্বংস : বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে জীববৈচিত্র্য মারাত্মক হুমকির মুখে পড়েছে। বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে ভূ-পৃষ্ঠের তাপমাত্রাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। যার প্রভাবে বনাঞ্চলসমূহ ধ্বংস হওয়ার আশংকা দেখা দিচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ ও জলজ প্রাণী বিলুপ্তির পথে। পরিবেশ ও ভূ-বিজ্ঞানীদের মতে, সমুদ্রের উচ্চতা মাত্র ১ মিটার বৃদ্ধি পেলে সুন্দরবনের ৭০ ভাগ তলিয়ে যাবে। জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হয়ে গেলে তা বিশ্বের জন্য অত্যন্ত ভয়াবহ ফলাফল বয়ে আনবে। পরিবেশ তার ভারসাম্য হারিয়ে ফেলবে।

৫. নদ-নদীর প্রবাহ-হ্রাস এবং পানির লবণাক্ততা বৃদ্ধি : বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ। জমিতে সেচ ও নৌ-চলাচলের জন্য নদ-নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে নদ-নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ বিঘ্নিত হয়। এর ফলে প্রধান প্রধান নদীর প্রবাহ হ্রাস পাবে এবং নদীর ক্ষীণ প্রবাহের কারণে সামুদ্রিক লোনা পানি সহজে দেশের অভ্যন্তরীণ নদীপ্রবাহে প্রবেশ করে নদ-নদীর পানিতে লবণাক্ততা বাড়িয়ে দেবে। ফলে সামুদ্রিক লোনা পানি উজান অঞ্চলে প্রবেশ করায় কৃষিতে প্রয়োজনীয় মৃদু পানির অভাব দেখা দেবে এবং দেশের সম্পদের বিপুল পরিমাণ ক্ষতি সাধিত হবে। বর্তমানে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে ও দূরবর্তী দ্বীপসমূহের প্রায় ১.৪ মিলিয়ন হেক্টর এলাকায় লোনা পানি প্রবেশ করায় উম্মুক্ত জলাশয় ও ভূগর্ভস্থ পানি লবণাক্ত হয়ে পড়েছে। জলবায়ু পরিবর্তিত হওয়ার সাথে সাথে এই লবণাক্ততার মাত্রা আরও বৃদ্ধি পাবে।

৬. আকস্কিক বন্যা : পাহাড়ি ঢলের কারণে বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বিশেষত মেঘনা অববাহিকায় প্রতিবছর আকস্মিক বন্যা দেখা যায়। দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে প্রায় ৪ হাজার বর্গ কিলোমিটার এবং দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের প্রায় ১ হাজার ৪০০ বর্গ কিলোমিটার এলাকা এ ধরনের আকস্মিক বন্যার শিকার। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বৃষ্টিপাত ও পাহাড়ি ঢলের পরিমাণ আরো বেড়ে যাচ্ছে। ফলে আকস্মিক বন্যার পৌনঃপুনিকতা, ক্ষতির পরিমাণ ও তীব্রতা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাবে। বর্তমানে দেশের উত্তরাঞ্চলে বিশেষত সিরাজগঞ্জ ও এর আশপাশের এলাকাসমূহে বন্যা ভয়াবহ রূপ ধারণ করে।

৭. নদী ভাঙন : বাংলাদেশে মোট সমুদ্র তটরেখার পরিমাণ ৭১১ কিলোমিটার এর মধ্যে সুন্দরবন উপকূল ঘিরে রয়েছে ১২৫ কিলোমিটার এবং কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত ১২০ কিলোমিটার দীর্ঘ (সূত্র-বাংলাপিডিয়া)। এছাড়া সমুদ্র উপকূল বরাবর রয়েছে গঙ্গা ও মেঘনা অববাহিকায় অবস্থিত অসংখ্য প্রশস্ত জোয়ার ভাটা সমভূমি এবং নদী মোহনায় রয়েছে বদ্বীপ। নদীসঙ্গমে অবস্থিত এসব বদ্বীপ ও সমুদ্র তটরেখা বরাবর ভূখণ্ড প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল। কিন্তু এ পরিবর্তনশীল বৈশিষ্ট্যের মাঝে এক বিশেষ ভারসাম্য বজায় থাকে। কিন্তু বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি পেলে এ ভারসাম্য বিঘ্নিত হবে। বর্তমানে দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে নদী ভাঙনের তীব্রতা বৃদ্ধি পেয়েছে। অতিরিক্ত বৃষ্টিপাতের ফলে মেঘনা ও পদ্মার তীরবর্তী এলাকাসমূহে নদী-ভাঙনের ফলে বাংলাদেশের বিপুল পরিমাণ জনগোষ্ঠী সর্বস্বান্ত হয়ে পড়েছে।

৮. খরা : মাটিতে আর্দ্রতার অভাব অর্থাৎ বৃষ্টিপাতের তুলনায় বাষ্পীভবনের মাত্রা বেশি হলে খরা দেখা দেয়। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে জলবায়ু পরিবর্তিত হচ্ছে যার প্রভাব বাংলাদেশেও দেখা দিচ্ছে। বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে বর্ষাকালে প্রয়োজনীয় বৃষ্টিপাত ও পানির অভাবে কৃষিকাজ মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে এবং ফসল উৎপাদনও ক্রমাগতভাবে হ্রাস পাচ্ছে। শীতকালেও এ অঞ্চলে বৃষ্টিপাতের তুলনায় বাষ্পীভবনের হার বেশি। এর ফলে মাটির আর্দ্রতা হ্রাস পায় এবং কৃষিকাজের ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হচ্ছে। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির সাথে সাথে খরার প্রকোপ আরো বৃদ্ধি পাবে এবং বর্তমানের মাঝারি ধরনের খরা উপদ্রুপ এলাকা মারাত্মক খরা উপদ্রুপ এলাকায় পরিণত হবে।

৯. সামুদ্রিক ঝড় ও জলোচ্ছ্বাস : সাধারণত সামুদ্রিক ঝড় সৃষ্টি হয় উত্তপ্ত বায়ু ও ঘূর্ণিবায়ু থেকে। ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টির পেছনে অন্যান্য প্রক্রিয়া সক্রিয় থাকলেও পানির উত্তাপ বৃদ্ধিই মূল কারণ। বাংলাদেশে প্রতিবছর মে-জুন মাসে যে সামুদ্রিক ঝড় হয় তাতে উপকূলীয় জেলাসমূহে ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি পাওয়ার সাথে সাথে সমুদ্রের পানির তাপমাত্রাও ক্রমবর্ধমান হারে বেড়ে যাবে। স্বাভাবিকভাবেই সামুদ্রিক ঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের তীব্রতাও বেড়ে যাবে। সাম্প্রতিক সময়ে ‘সিডর’ বাংলাদেশে যে ধ্বংসযজ্ঞের চিহ্ন রেখে গেছে তা বর্ণনাতীত। পরিবেশ বিজ্ঞানীদের মতে এটা বাংলাদেশের জন্য বড় ধরনের আঘাত। সিডর, সুনামি, সাইক্লোনসহ অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ মূলত জলবায়ুর দ্রুত পরিবর্তনেরই ফলাফল। আর পরিবেশ দূষণের ফলে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধিই জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী। মানব সৃষ্ট দূষণের ফলে জলবায়ু পরিবর্তনের যে ধারা ‍সৃষ্টি হয়েছে, বাংলাদেশের জন্য তা সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ। দূষণের জন্য বিশ্বের শিল্পায়িত দেশগুলোর দায়ভার সবচেয়ে বেশি। কিন্তু এখন পর্যন্ত অনেক ধনী রাষ্ট্রই ‘কিয়োটো প্রটোকল, ১৯৯৭’ কার্যকর করেনি।

বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি ও বাংলাদেশে সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতি : বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে জলবায়ু পরিবর্তন ও এর প্রভাবে সম্ভাব্য ক্ষয়-ক্ষতি ইতোমধ্যে বিশ্বজুড়ে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশ ও তার প্রতিবেশী দেশসমূহে ক্ষয়-ক্ষতির মাত্রা অত্যন্ত ব্যাপক হবে বলে পরিবেশ ও ভূ-বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে বাংলাদেশের উচ্চতা কম থাকার কারণে বাংলাদেশে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আরও ভয়াবহ হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ নিয়মিত প্রাকৃতিক দুর্যোগের সম্মুখীন হচ্ছে যা জলবায়ু পরিবর্তনেরই ফলাফল। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে বাংলাদেশে যে সকল ক্ষতি হতে পারে তা নিম্নরূপ:

ক. বিপন্ন জনগোষ্ঠী : বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থার প্রেক্ষিতে কোনো মাঝারি ধরনের প্লাবনে দেশের ৬৫ শতাংশ জনগোষ্ঠী প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়বে এবং প্লাবন এলাকার পরিধি ক্রমেই বাড়তে থাকবে। ফলে বিপুল জনগোষ্ঠীর জীবন ও জীবিকা বিপন্ন হয়ে পড়বে।

খ. অবকাঠামোগত ক্ষয়ক্ষতি : ১৯৯০ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী বাংলাদেশে মোট বাস্তুগত সম্পদের পরিমাণ ১৮০০০ বিলিয়ন টাকা। এর মধ্যে ভৌত অবকাঠামো রয়েছে ২৮০ বিলিয়ন টাকা মূল্যের। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি ও সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে প্লাবনের তীব্রতা বাড়বে এবং অবকাঠামোগত ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হবে। IPCC-এর সমীক্ষা অনুয়যায়ী ২০১০ সাল নাগাদ বাংলাদেশে প্লাবনজনিত কারণে বস্তুগত সম্পদের ক্ষতির পরিমাণ হবে ২৪২ মিলিয়ন টাকা।

গ. বিপন্ন কৃষি : বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি পেলে বাংলাদেশের কৃষি খাত মারত্মক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হবে। কৃষিখাতের ওপর এ বিপর্যয় দেশের আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার ওপর ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। IPCC-এর সমীক্ষা অনুয়ায়ী প্লাবনের কারণে দেশে আমন ধানের উৎপাদন ১৩.৬ মিলিয়ন মেট্রিক টন হ্রাস পাবে। এমনকি জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দেশের কৃষি উৎপাদন বর্তমানের তুলনায় প্রায় ৭০ শতাংশ কমে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। শীত মৌসুমে বাংলাদেশে প্রায় ৩৬০০ বর্গ কিমি এলাকা খরার কবলে পড়ে। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির সাথে সাথে খরার ব্যাপ্তি আরো বেড়ে তা ২২০০ কিমি পর্যন্ত সম্প্রসারিত হবে। গত কয়েক দশক ধরে বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে বর্ষা মৌসুমের ফসলের ওপর খরার প্রতিকূল প্রভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তন হলে দেশের মধ্য-দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে গমের আবাদ অসম্ভব হয়ে পড়বে এবং আলুর চাষও ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়বে। এছাড়া প্রয়োজনীয় সেচের অভাবে দেশের উত্তর-পশ্চিম ও মধ্য-পশ্চিমাঞ্চলে চাষাবাদ ব্যাপকভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হবে।

ঘ. লোনা পানির অনুপ্রবেশ : দেশের মোট জনসংখ্যার ১৫ শতাংশ সমুদ্র তীরবর্তী অঞ্চলে বসবাস করে। IPCC-এর সমীক্ষা অনুযায়ী সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ১০০ সেমি বৃদ্ধি পেলে ২৫,০০০ বর্গ কিমি এলাকায় লোনা পানির অনুপ্রবেশ ঘটবে। ফলে দেশের প্রায় ৩ কোটি ৫০ লাখ লোকের জীবন ও জীবিকা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এছাড়া লোনা পানি প্রবেশের ফলে দেশের চিংড়ি শিল্প ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হবে। দেশের নদ-নদীতে লোনা পানির অনুপ্রবেশ ঘটলে স্বাদু পানির মৎস্য সম্পদ ধ্বংস হবে এবং জলজ প্রাণী ও উদ্ভিদের জীবন বিপন্ন হবে।

ঙ. পরিবেশ বিপর্যয় : বাংলাদেশের জনসংখ্যার তুলনায় প্রাকৃতিক সম্পদ অত্যন্ত অপ্রতুল। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি পেলে জলবায়ুতে যে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবে তা বাংলাদেশের জন্য ভয়াবহ পরিণাম ডেকে আনবে। জলবায়ু পরিবর্তিত হলে সম্পদের অপ্রাপ্যতা আরো বেড়ে যাবে এবং প্রাকৃতিক সম্পদ দ্রুত বিনষ্ট হবে। ইতোমধ্যে দেশের বৃহৎ বনভূমি সুন্দরবন ও হাওর অঞ্চলের পরিবেশীয় ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছে।

বৈশ্বিক উষ্ণতা রোধে আমাদের করণীয় : বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি শুধুমাত্র বাংলাদেশের জন্য নয় বরং সমগ্র বিশ্ব ও মানবজাতির জন্য হুমকিস্বরূপ। ভৌগোলিক অবস্থান ও ভূ-প্রাকৃতিক অবকাঠামো বাংলাদেশকে যতটা কুফলভোগী করেছে, এ সংকট সৃষ্টিতে আমাদের দেশের ভূমিকা শিল্পোন্নত দেশের তুলনায় খুবই নগণ্য। এখনই সময় এ সংকট মোকাবিলায় এগিয়ে আসার। বৈশ্বিক উষ্ণতা রোধে আমাদের সবচেয়ে যে বিষয়গুলোর ওপর জোর দিতে হবে তা হলো-

১. ব্যাপকভাবে বনায়ন কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। এ ধারাবাহিকতায় দেশের সমুদ্র উপকূলবর্তী এলাকায় ও নদী তীরবর্তী এলাকাসমূহে বনায়ন কর্মসূচি যত দ্রুত সম্ভব শুরু করতে হবে। ফলে নদী ভাঙন ও সামুদ্রিক ঝড়ের তীব্রতা কমে যাবে।
২. বৃক্ষনিধন রোধ করতে হবে। কারণ বৃক্ষই প্রকৃতি থেকে ক্ষতিকর কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাস শোষণ করে এবং অক্সিজেন নির্গমন করে। ফলে পরিবেশের ভারসাম্য বজায় থাকে।
৩. বায়ুমণ্ডলের উত্তাপ বাড়ায়, এমন ক্ষতিকর গ্যাসের নির্গমন কমাতে হবে।
৪. পরিবেশ সহায়ক জ্বালানির ব্যবহার বাড়াতে হবে।
৫. শিল্পকারখানার জ্বালানি সাশ্রয় করতে হবে এবং উৎপন্ন বর্জ্য বিশুদ্ধকরণের ব্যবস্থা নিতে হবে।
৬. সর্বোপরি দেশের সবাইকে এ ভয়াবহ দুর্যোগ মোকাবিলায় এগিয়ে আসতে হবে।

উপসংহার : একবিংশ শতাব্দীর সন্ধিক্ষণে মানবজাতি যখন সভ্যতার চরম শিখরে, ঠিক তখনই এ মানবজাতি তার পরিবেশকে ঠেলে দিচ্ছে চরম বিপর্যয়ের দিকে। মানুষ তার প্রয়োজনে একদিকে যেমন পরিবেশ ও প্রাকৃতিক সম্পদকে ব্যবহার করছে অপরদিকে পরিবেশকে করে তুলছে বিষাক্ত। পরিবেশ দূষিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত এবং পরিবেশের ভারসাশ্য দ্রুত বিনষ্ট হচ্ছে। এ বিশ্ব আমাদেরই, আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে তাই এ ভয়াবহ বিপর্যয়ের হাত থেকে বাঁচাতে আমাদেরই এগিয়ে আসতে হবে।

 বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তন রচনা ২

ভূমিকা : সারা বিশ্বের যেসব সমস্যা মানুষকে গভীরভাবে নাড়া দিয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তন তাদের মধ্যে অন্যতম। পৃথিবীর প্রায় সব দেশের সরকার ও বিজ্ঞানীরা স্বীকার করেছেন যে, জলবায়ু পরিবর্তন মানবসভ্যতা ও প্রকৃতির জন্য বড় বিপদ। শুধু ইন্টার গভর্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ (IPCC)-এর গবেষণাই নয়, অনেক আগেই বৈজ্ঞানিক গবেষণাগুলো বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে সতর্ক করে আসছে। ফলে পৃথিবী এক ভয়াবহ সংকটের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। সারা বিশ্বের পরিবেশ সচেতন মানুষ ও সংগঠন এখন জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে একটি বৈশ্বিক আন্দোলন গড়ে তুলতে চাচ্ছে। বিশেষ করে যেসব দেশ সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়তে পারে—যেমন বাংলাদেশ, মালদ্বীপ, নেপাল ও আফ্রিকার কিছু দেশ—সেসব দেশের মানুষ ও পরিবেশবাদীরা নিজেদের রাজনৈতিক নেতাদের উপর চাপ দিচ্ছে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে। যদি এখনই প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ না করা হয়, তাহলে একদিন বাংলাদেশের মতো নিচু অঞ্চলগুলো পৃথিবীর মানচিত্র থেকেই হারিয়ে যেতে পারে।

জলবায়ু : কোনো স্থানের একটি নির্দিষ্ট সময়ের বায়ুর তাপমাত্রা, বায়ুর গতি, বৃষ্টিপাত এবং বায়ুচাপের অবস্থা মিলেই সেই সময়ের আবহাওয়া গঠন করে। আবহাওয়া সবসময় একরকম থাকে না, এটি সময় অনুযায়ী বদলায়। কারণ বায়ুর তাপমাত্রা, বৃষ্টিপাত, ও আর্দ্রতার মতো উপাদানগুলো মিনিটে মিনিটে বা ঘণ্টায় ঘণ্টায় পরিবর্তিত হয়। দীর্ঘ সময়, অর্থাৎ প্রায় ২৫ থেকে ৩০ বছর ধরে কোনো স্থানের আবহাওয়ার গড় পরিস্থিতিকে সেই স্থানের জলবায়ু বলা হয়। সহজভাবে বললে, আবহাওয়ার দীর্ঘ সময়ের গড় অবস্থাই হলো জলবায়ু।

জলবাযুর উপাদান : আবহাওয়ার ন্যায় জলবায়ুরও প্রধান উপাদান হচ্ছে বায়ুর তাপ, আর্দ্রতা, বৃষ্টিপাত, বায়ুর চাপ ইত্যাদি। তবে এসব নিয়ন্ত্রণ করে অক্ষাংশ, ভূ-পৃষ্ঠের উচ্চতা, সমুদ্র হতে দূরত্ব, বায়ু প্রবাহের দিক, সমুদ্র স্রোত ইত্যাদি। আবহাওয়ার উপাদানসমূহ ও তাদের নিয়ন্ত্রণকারী নিয়ামকসমূহ পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে আবহাওয়া জলবায়ুর ও পরিবর্তন হয়।

জলবায়ুর প্রকারভেদ : জলবায়ুকে সাধারণত ৬ ভাগে ভাগ করা হয়ে থাকে; যেমন: নাতিশীতোষ্ণ জলবায়ু, চরমভাবাপন্ন জলবায়ু, সমভাবাপন্ন জলবায়ু, আর্দ্র জলবায়ু, শুষ্ক জলবায়ু, সামুদ্রিক জলবায়ু। এজন্য এলাকাভেদে জলবায়ুর তারতম্য লক্ষ্য করা যায়। তবে এলাকা বা প্রাকৃতিক অঞ্চলগুলো কোন নির্দিষ্ট সীমারেখা দ্বারা পৃথক করা সম্ভব নয়।

জলবায়ুর পরিবর্তন : জলবায়ু অপরিবর্তনীয় বিষয় নয়, এটি পরিবর্তনশীল। জলবায়ুর চিরাচরিত অবস্থায় ও আচরণে যখন লক্ষণীয় অসামঞ্জস্য দেখা দেয় তখনই তাকে বলা হয় জলবায়ু পরিবর্তন। গত শতাব্দীর শেষপাদে এসে বিশ্বের পরিবেশবিদগণ লক্ষ্য করেন যে, সারা বিশ্বের জলবায়ুর ক্ষেত্রে বহু ধরণের পরিবর্তন এসেছে। এ পরিবর্তনের অন্যতম দিক হচ্ছে, বৈশ্বিক উষ্ণায়ন বা আবহাওয়া মণ্ডলের উত্তাপ বৃদ্ধি। ঋতুচক্রের শৃঙ্খল ভেঙে যাওয়া বা ঋতুবৈশিষ্ট্যে পরিবর্তন, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, অকালবন্যা, সামুদ্রিক ঝড়, দাবানল, সর্বোপরি সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি প্রভৃতির প্রকোপ।

জলবায়ু বিবর্তন বা পরিবর্তনের প্রমাণ : জলবায়ু যে পরিবর্তনশীল তা আজ প্রমাণিত। পাললিক শিলার গঠন বৈশিষ্ট্য থেকে পৃথিবীর আদি কালের জলবায়ু সম্পর্কে জানা যায়। হিমবাহ দ্বারা সঞ্চিত শিলাচূর্ণ হতে অতীত হিমবাহ সংশ্লিষ্ট জলবায়ুর আভাস পাওয়া যায়। সাধারণত জিপসাম ও লবণ খণির অস্তিত্ব অতীতের শুষ্ক জলবায়ুর অবস্থান উল্লেখ করে। তবে চুনা-পাথরের অস্তিত্ব হতে উষ্ণ জলবায়ুর প্রমাণ পাওয়া যায়। অতীতকালের স্বাভাবিক জলবায়ু ছিল মৃদুভাবাপন্ন। সিলুরিয়ান, নিম্ন কার্বনিফোরাস, জুরাসিক, ইয়োসিন প্রভৃতি ভূতাত্বিক যুগে পৃথিবীর জলবায়ু স্বাভাবিক ধরনের ছিল।

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণ : আজ পৃথিবী ধ্বংসের পথে, আর এই ধ্বংসের মূল কারণ মানুষ নিজেই। জলবায়ুর অস্বাভাবিক পরিবর্তনের পেছনে মানুষের কর্মকাণ্ড দায়ী—এ বিষয়ে বিজ্ঞানীরা একমত। আগুন জ্বালানোর ফলে অক্সিজেন কমে যায়, আর বেশি আগুন মানেই বেশি অক্সিজেনের ক্ষয়। বায়ুমণ্ডলের ভারসাম্য রক্ষায় যেখানে ২০.৭১% অক্সিজেন ও ০.০৩% কার্বন-ডাই-অক্সাইড দরকার, সেখানে অতিরিক্ত গাছ কেটে ফেলায় কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে। এর ফলে পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়ছে, মেরুর বরফ গলছে এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতাও বাড়ছে। একই সঙ্গে ওজোন স্তরের ক্ষয় ও গ্রিন হাউস ইফেক্টের কারণে বিশ্ব ক্রমশ উষ্ণ হয়ে উঠছে। সিএফসি গ্যাস ও জীবাশ্ম জ্বালানির ধোঁয়া জলবায়ু পরিবর্তনের এই ভয়াবহ সমস্যাকে আরও বাড়িয়ে তুলছে।

জলবায়ুর পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব : জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণে আমাদের প্রকৃতিতে যে বিরূপ প্রভাব পড়ছে তা নিচে আলোচনা করা হলো:

১। সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি : পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে মেরু অঞ্চলে ও সুউচ্চ পর্বতে জমে থাকা বরফরাশি গলতে শুরু করেছে। বরফগলা পানি সমুদ্রপৃষ্ঠকে স্ফীত করে তুলেছে। ২০০৭ সালে জাতিসংঘের আন্ত সরকার জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত প্যানেলের (আইপিসিসি) প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, ২০৫০ সালের মধ্যে বঙ্গোপসাগরের পানি উচ্চতা এক মিটার বাড়বে। এর ফলে বাংলাদেশের উপকূলের ১৭ শতাংশ ভূমি ডুবে যাবে। আগামী ২৫ বছরের মধ্যে মালদ্বীপ রাষ্ট্রটি পৃথিবীর মানচিত্র থেকে মুছে যাবে।

২। বন্যা : পৃথিবীর আবহাওয়া যেভাবে পরিবর্তন হচ্ছে তা যদি অব্যাহত থাকে তবে ঘনঘন বন্যা হবে। ইতোমধ্যেই জোয়ার ভাটাজনিত বন্যা, মৌসুমী বন্যা,  অতিবৃষ্টিজনিত বন্যার পাশাপাশি আকস্মিক বন্যা পৃথিবীর জন্য হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। উন্নত বিশ্ব থেকে শুরু করে তৃতীয় বিশ্বের প্রায়ই অধিকাংশ দেশই এই নির্মম পরিবেশের কবলে পড়েছে।

৩। ঝড়-জলোচ্ছাস : জলবায়ুর পরিবর্তনে সমুদ্রে এল নিনিও প্রভাবে ঝড় ও জলোচ্ছ্বাস বাড়িয়ে দিয়েছে। বিগত দুই দশক ধরে সুনামি, সিডর, আইলা, নার্গিস, হারিকেন, টাইফুন, টর্নেডো প্রভৃতির ভয়াবহতা বিশ্ববাসীকে আতঙ্কিত করে তুলছে।

৪। লবণাক্ততা বৃদ্ধি : সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাওয়ায় উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ত পানি প্রবেশ করে ফসলের ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি করছে। ভূমি চাষাবাদের অনুপযুক্ত হয়ে যাচ্ছে। পরিণতিতে অর্থনীতির উপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। মানুষের জীবন যাত্রার মান নিচে নেমে যাচ্ছে।

৫।  অনাবৃষ্টি, অতিবৃষ্টি ও দাবানল : জলবায়ুর পরিবর্তনে একদিকে যেমন অতিবৃষ্টি হচ্ছে অন্যদিকে তেমনি অনাবৃষ্টিতে দীর্ঘস্থায়ী খরার প্রকোপ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। আর অস্বাভাবিকভাবে তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় বনাঞ্চলে আকস্মিক আগুন লেগে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র, অষ্ট্রেলিয়া, কানাডা, জাপান প্রভৃতি দেশে দাবানল ব্যাপাক ক্ষতি সাধন করছে।

৬। ঋতুচক্রে পরিবর্তন : আষাঢ় মাসে এখন আর বৃষ্টি খুব একটা দেখা যায় না। তেমনি পৃথিবীর প্রতিটি এলাকাতেই সময়মত ঋতু শুরু হয় না। বর্ষাকালে বৃষ্টি নেই, শীতকালে শীত নেই আবার বসন্তকালে মনে হয় গ্রীষ্মকাল। ঋতু দেরিতে আসে আবার দেরিতে বিদায় নেয়। ফলে জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হয়।

বাংলাদেশের জলবায়ু : যেসব দেশ জলবায়ু পরিবর্তনে সবচেয়ে বেশি হুমকির সম্মুখীন তার মধ্যে বাংলাদেশ শীর্ষে। নাতিশীতোষ্ণ মন্ডলে বাংলাদেশের অবস্থান। গ্রীষ্মকালে বাংলাদেশে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং সর্বনিম্ন ২১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। শীতকালে সর্বোচ্চ ২৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস সর্বনিম্ন ১১ ডিগ্রি সেলসিয়াস, বর্ষাকালের গড় তাপমাত্রা ২৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস থাকে। বার্ষিক গড় তাপমাত্রা ২৬.০১ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং গড় বৃষ্টিপাত ২০৩ সেন্টিমিটার। শীত, গ্রীষ্ম ও বর্ষা-এ তিনটি ঋতু এদেশে চরমভাবাপন্ন।

বাংলাদেশের জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব : পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ২০০৭ সালে জাতিসংঘের আন্তসরকার জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত প্যানেলের (আইপিসিসি) প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, ২০৫০ সালের মধ্যে বঙ্গোপসাগরের পানির উচ্চতা এক মিটার বাড়বে। এর ফলে বাংলাদেশের উপকূলের ১৭ শতাংশ ভূমি ডুবে যাবে। এর ফলে প্রায় ৫  কোটি মানুষ বাস্তুচ্যুত হবে। খরা, বন্যা, অতিবৃষ্টি, নদীভাঙ্গন, সামুদ্রিক ঝড় সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মানুষের জীবনকে বিপর্যস্ত করে তুলেছে। সিডর, আইলা, নার্গিসের ক্ষতচিহ্ন এখনও শুকায়নি। ২০০৯ সালের ২৩ জুন দেশে ইতিহাসের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়। ২০০৯ সালের ২৮শে জুন মাত্র ৬ ঘন্টায় দেশে ৩৩৩ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়। উত্তরবঙ্গে মরুকরণ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এদেশে সময়মত বৃষ্টিপাত হচ্ছে না। সময়মত শীত আসছে না আবার প্রায় সারা বছরই গ্রীষ্মের দাবদাহ থাকছে।

বাংলাদেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন সম্মেলন : কোপেনহেগেনে ৭ই ডিসেম্বর ২০০৯ শুরু হওয়া জাতিসংঘ জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক সম্মেলনে ১৯৩টি দেশ অংশগ্রহণ করে। ১৯শে ডিসেম্বর একটি অঙ্গীকার নামায় স্বাক্ষরের মাধ্যমে শেষ হয়। এতে উন্নত দেশ অঙ্গীকার করে তারা উন্নয়নশীল দেশগুলোকে ৩০ বিলিয়ন ডলার সাহায্য দেবে। পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে খাপ খাইয়ে নেয়ার জন্য দরিদ্র দেশগুলোকে ২০২০ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর ১০০ বিলিয়ন ডলার সাহায্যের রূপরেখা প্রণয়ন করা হয়েছে। বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্থ দেশ হওয়ায় ১৫ শতাংশ সাহায্যের আশা করছে।

জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রভাব নিয়ে বিজ্ঞানীদের নতুন তথ্য : বাংলাদেশ সরকারের প্রাকৃতিক সম্পদ বিষয়ক গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড জিওগ্রাফিক্যাল ইনফরমেশন সার্ভিসেস (সিইজিআইএস) বলেছে, হিমালয় পর্বতমালা থেকে প্রতিবছর ২০০ কোটি টন পলি বঙ্গোপসাগরে এসে পড়ে। সমুদ্রের জোয়ার-ভাটার টানে তা বাংলাদেশের উপকূলে এসে জড়ো হয়ে নতুন ভূমি গঠন করে। এভাবে গত ৬৫ বছরে বাংলাদেশের উপকূলে এক হাজার ৮০০ বর্গকিলোমিটার ভূমি জেগে উঠেছে। ফলে সমুদ্রের পানি বেড়ে গেলেও উপকূলীয় এলাকায় পলি পড়ার ফলে ভূমির স্তর বৃদ্ধি পাওয়ায় এসব এলাকা সমুদ্রে বিলীন হবে না।

উপসংহার : যে অপরাধ বাংলাদেশ করে নি অথচ সেই অপরাধের জন্য তাকে ফাঁসির রজ্জুতে ঝুলতে হবে। অর্থাৎ বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধিতে বাংলাদেশের কোনো হাত ছিল না, অথচ এর প্রভাব বাংলাদেশকে ভুগতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনে যে সি.এফ.সি. গ্যাস দায়ী তার শতকরা ৮৫ ভাগই উৎপন্ন করে উন্নত দেশগুলো। উন্নত বিশ্ব যদি সিএফসি গ্যাস উৎপন্ন অব্যাহত রাখে তবে বাংলাদেশ এক জটিল অবস্থার মুখোমুখি হবে। পৃথিবীর অনেক দেশই বাংলাদেশের সঙ্গী হবে। তাই  জলবায়ু পরিবর্তন রোধে এখনই সময় বিশ্বকে একতাবদ্ধ হতে হবে। এর ব্যতিক্রম হলে এক সময় পৃথিবীর কাগজের মানচিত্রে বাংলাদেশের শুধু ছবি থাকবে, বাস্তব দেশটি থাকবে না।

রচনাটি যদি ভালো লেগে থাকে, তাহলে আরও অনেক রচনা পড়তে ভিজিট করুন আমাদের ওয়েবসাইটে — StudyTika.com। এখানে পাওয়া যাবে সহজ ভাষায় অনেক সুন্দর রচনা।

Getting Info...

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Oops!
It seems there is something wrong with your internet connection. Please connect to the internet and start browsing again.