গ্রন্থাগার রচনা Class 7 8 9 10 ‍SSC HSC (২০+ পয়েন্ট)

 ভূমিকা: এই ব্লগপোস্টে রয়েছে একটি সুন্দর ও সহজ ভাষায় লেখা "গ্রন্থাগার রচনা"। চলুন, রচনাটি পড়ে জেনে নিই।

গ্রন্থাগার রচনা Class 7 8 9 10 ‍SSC HSC (২০+ পয়েন্ট)

গ্রন্থাগার রচনা ১

ভূমিকা : গ্রন্থাগার হল মানুষের চিন্তা-ভাবনা, জ্ঞান ও ধ্যান-ধারণার এক নিরব আশ্রয়স্থল। এখানে বই ও পুঁথির মাধ্যমে মানুষের জ্ঞানকে যুগের পর যুগ ধরে সংরক্ষণ করা হয়। এটি মানব সভ্যতার জ্ঞানকে অমর করে রাখার এক মহান প্রচেষ্টা। এই জ্ঞানের ভাণ্ডার মানুষের মনে সুখ ও তৃপ্তি এনে দেয়। পুঁথির অমূল্য কথা ও তথ্য সেই তৃপ্তির দরজা খুলে দেয়। তাই মানুষ বই সংগ্রহ করে একটি গ্রন্থাগার গড়ে তোলে, যেখানে সে জ্ঞান লাভের পিপাসা মেটায়। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একে তুলনা করেছেন এক নিঃশব্দ অথচ গভীর শব্দের সাথে, যেখানে “মহাসমুদ্রের শত বছরের কল্লোল” যেন ঘুমন্ত শিশুর মতো চুপ করে থাকে। এই গ্রন্থাগারে ভাষা চুপ করে থাকে, জ্ঞানের প্রবাহ স্থির থাকে, আর মানব আত্মার অমর আলো যেন কাগজে কালো অক্ষরের শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়ে থাকে।

গ্রন্থাগার কী? : শিক্ষান্বেষী মানুষের কাছে গ্রন্থাগার এক চির-কাঙ্ক্ষিত জ্ঞান-তীর্থ, সেখানে সে তার মুক্তির সন্ধান পায়। খুঁজে পায় এক দুর্লভ ঐশ্বর্যের খনি। গ্রন্থাগারেই পাঠক সভ্যতার এক শাশ্বত ধারার স্পর্শ পায়, অনুভব করে মহাসমুদ্রের শত শত বছরের হৃদয় কল্লোল, শুনতে পায় জগতের এক মহা ঐকতান ধ্বনি। দেশে দেশে হৃদয়ে রচিত হয় অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যতের সেতুবন্ধন। তাই রবীন্দ্রনাথ বলেছেন- ‘বিদ্যুৎকে মানুষ লোহার তার দিয়ে বাঁধিয়াছে, কিন্তু কে জানিত মানুষ শব্দকে নিঃশব্দের মধ্যে বাঁধিতে পারিবে! কে জানিত সংগীতকে, হৃদয়ের আশাকে, জাগ্রত আত্মার আনন্দ ধ্বনিকে, আকাশের দৈববাণীকে সে কাগজে মুড়িয়া রাখিবে! কে জানিত মানুষ অতীতকে বর্তমানে বন্দী করিবে? অতল-স্পর্শ কালসমুদ্রের ওপর কেবল এক-একখানি বই দিয়া সাঁকো বাঁধিয়া দিবে।’

গ্রন্থাগারের উদ্ভব : সভ্যতার ক্রমবিকাশের মত গ্রন্থাগারেরও রয়েছে এক ক্রমবিবর্তনের ইতিহাস। ধারণা করা হয় প্রাচীন রোমেই সর্বসাধারণের জন্যে প্রথম গ্রন্থাগার স্থাপিত হয়েছিল। এর আগেও গ্রন্থাগারের অস্তিত্বের প্রমাণ পাওয়া গেছে। ব্যবিলনের ভূগর্ভ খনন করে আবিষ্কৃত-হয়েছে সাড়ে চার হাজার বছরের পূর্বেকার একে গ্রন্থাগার। সন্ধান মিলেছে খ্রিস্টপূর্ব ছ’শ বছর আগের আসিরিয়ার রাজা আসুরবানিপালের নিজস্ব গ্রন্থাগারের সঞ্চিত পোড়ামাটির গ্রন্থ। খ্রিস্টপূর্ব চার’শ বছর আগে আলেকজান্দ্রিয়ায় ছিল গ্রিক শাসনকর্তা প্রথম টলেমি প্রতিষ্ঠিত প্রাচীনকালের বৃহত্তম গ্রন্থাগার। লাইব্রেরির প্রথম ধারণা দেন রোমান সম্রাট জুলিয়াস সিজার। তিনি যাকে দায়িত্ব দিলেন সেই মার্কাস ভালো একজন সুলেখক ছিলেন। তিনি লাইব্রেরির ওপর রচনা করেন একটি গ্রবেষণা-গ্রন্থ। পরবর্তী পাঁচ বছরের মধ্যেই তৈরি হয় লাইব্রেরি কিন্তু বন্ধু ব্রুটাসের হাতে নিহত হওয়ায় সিজার সেই লাইব্রেরি দেখে যেতে পারেন নি।

অথচ মধ্যযুগের সব বিজেতা জাতিই বিজিতের ধর্ম ও সংস্কৃতিকে ধ্বংস করার এক উন্মাদ মানসিকতায় ভুগতেন। মুসলমান আক্রমণের শুরু থেকেই তাদের লক্ষ্য ছিল অমূল্য গ্রন্থাগারের ধ্বংসসাধন। তাদের হিংস্রতার আগুনে ভস্মীভূত হয় হাজার হাজার বছরের সংগৃহীত দুর্লভ সম্পদ, মানুষের সাধনার অক্ষয় কীর্তি অজস্র গ্রন্থ-সম্ভার। আলেকজান্দ্রিয়ার সুবিশাল গ্রন্থাগার চেঙ্গিস খাঁর আক্রমণে বিধ্বস্ত হল। ধ্বংস হল বাগদাদ সেকেন্দ্রিয়ার গ্রন্থাগার। আজও চলছে ধ্বংসের উন্মত্ততা। এই তো সেদিন মাত্র বর্বর-আমেরিকাবাসী অন্যায়ভাবে ইরাক আক্রমণ করে ধ্বংস করলো তাঁদের প্রাচীন ইতিহাস, ঐতিহ্য ও মূল্যবান গ্রন্থাগার। মানুষ হারালো এক মহৎ উত্তরাধিকার।

গ্রন্থাগারের বৈশিষ্ট্য : গ্রন্থাগার হল ভাবনা ও জ্ঞানের এক মিলনস্থল—এ যেন অক্ষরে গড়া এক সেতু, যা অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের মধ্যে যোগসূত্র স্থাপন করে। ঠিক যেমন নদীর স্রোত এক দেশ থেকে আরেক দেশে, এক যুগ থেকে আরেক যুগে প্রবাহিত হয়, তেমনি জ্ঞানের ধারা বইয়ের মাধ্যমে প্রবাহিত হয় মানুষের হৃদয় থেকে হৃদয়ে। এই কারণে গ্রন্থাগার হয়ে ওঠে জ্ঞানপিপাসু লক্ষ মানুষের নীরব আলাপনের এক পবিত্র স্থান। চিন্তাবিদ এখানে খুঁজে পান তাঁর নানা প্রশ্নের উত্তর, ভাবুক খুঁজে পান ভাবনার রস। মন ও হৃদয়ের যে ক্ষুধা, তার তৃপ্তির এমন আয়োজন আর কোথাও নেই। তাই গ্রন্থাগার হয়ে ওঠে ভাবনাতৃষ্ণ ও জ্ঞানতৃষ্ণ মানুষের জন্য এক প্রশান্তির সরোবর। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘লাইব্রেরী’ প্রবন্ধে বলেছেন, “লাইব্রেরীর মধ্যে আমরা সহস্র পথের চৌমাথার উপরে দাঁড়াইয়া আছি। কোনো পথ অনন্ত সমুদ্রে, কোনো পথ অনন্ত শিখরে, আবার কোনো পথ মানবহৃদয়ের গভীরে পৌঁছে দেয়। যেদিকে ইচ্ছা, সেদিকে এগিয়ে যাও—এই ছোট পরিসরের মধ্যেই মানুষ তার মুক্তির পথ সংরক্ষণ করে রেখেছে।”

গ্রন্থাগারের সুবিধা : অনন্ত বিশ্বের জ্ঞানরাজি এবং তার ভাবরাশিও অফুরন্ত। বিচিত্র ভাব ও চিন্তার বিষয়ে রচিত হয়েছে কত গ্রন্থসম্ভার। কোনো একজন ব্যক্তির পক্ষে সেই সব গ্রন্থ সংগ্রহ করা সম্ভব নয়। গ্রন্থাগার বহু মানুষের যৌথ প্রতিষ্ঠান। সেখানে বহু প্রয়াসের সংগৃহীত বহু গ্রন্থ পাঠের সুযোগ ঘটে। এছাড়া, গ্রন্থাগার থেকে আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা নিজ নিজ অভিরুচি অনুসারে যে কোনো বিষয়ে গ্রন্থ সংগ্রহ করে পাঠ করতে পারে।

গ্রন্থাগারের প্রকারভেদ : গ্রন্থাগার বলতে বিভিন্ন ধরনের গ্রন্থের সংগ্রহশালা বুঝায়। এ সংগ্রহ ব্যক্তিগত হতে পারে, আবার জনসাধারণ বা রাষ্ট্রেরও হতে পারে। ব্যক্তিগত সংগ্রহে বিশেষ ধরনের গ্রন্থের প্রতি পক্ষপাতিত্ব থাকা স্বাভাবিক। কারণ গ্রন্থ নির্বাচনে ব্যক্তিবিশেষের বহুজনের পছন্দ-অপছন্দকে গুরুত্ব দিতে হয়। তাই সেখানে গ্রন্থের বৈচিত্র্য যেমন সংখ্যাও তেমনি বেশি।

গ্রন্থাগারের বিভাজন : পৃথিবীর অনেক উন্নত দেশের তুলনায় আমাদের দেশে সাধারণ গ্রন্থাগারের সংখ্যা নগণ্য। তবে স্বাধীন দেশে এ শ্রেণীর জনহিতকর প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা যে বেড়েছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। বর্তমানে বিভিন্ন জেলা শহরে নতুন পুরাতন সাধারণ গ্রন্থাগার দেখা যায়। এছাড়া সমাজের বিভিন্ন ক্লাব ও জনহিতকর সংস্থা এ ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে থাকে। অন্যদিকে, রয়েছে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগার সভ্যসংখ্যা এসব জায়গায় সীমাবদ্ধ। শুধুমাত্র বিদ্যার্থী, শিক্ষক ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অশিক্ষক কর্মচারীরাই এগুলো ব্যবহারের সুযোগ পেয়ে থাকে। অফিস-আদালত এবং কারখানা ইত্যাদির ক্ষেত্রেও গ্রন্থাগার ব্যবহারের সুযোগ সেসব জায়গায় কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে সীমিত।

অতীত ও বর্তমানের বিখ্যাত গ্রন্থাগার : প্রাচীন যুগের বিখ্যাত গ্রন্থাগারের মধ্যে মিশরের আলেকজান্দ্রিয়া জাদুঘর বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। মুসলিম বিশ্বে কর্দোভা, দামেস্ক ও বাগদাদেও বেশ কিছু গ্রন্থাগার ছিল। বর্তমানে পৃথিবীর বিখ্যাত গ্রন্থাগারগুলোর মধ্যে ব্রিটেনের ব্রিটিশ মিউজিয়াম, ফ্রান্সের বিবলিওথিক ন্যাশনাল লাইব্রেরি, মস্কোর লেনিন লাইব্রেরি, আমেরিকার লাইব্রেরি অব কংগ্রেস, কলকাতার ন্যাশনাল লাইব্রেরি উল্লেখযোগ্য।

গ্রন্থাগারের প্রয়োজনীয়তা : আমাদের স্বাধীন দেশে শিক্ষার প্রসারের সাথে সাথে গ্রন্থাগারের প্রয়োজনীয়তা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। মানুষ ক্রমে উপলদ্ধি করছে, খাদ্যই সব নয়, মনেরও খাদ্য দরকার। গ্রন্থাগার পারে ক্লান্ত, বুভুক্ষু মানুষের মনকে প্রফুল্ল করতে, তাকে পছন্দমাফিক জিনিসের সন্ধান দিয়ে তার মনের খোরাক জাগাতে। এদিকে দেহের খাদ্যের বেলায় যেমন জনে জনে পার্থক্য ও রুচিভেদ, মনের খাদ্যের বেলায় অনুরূপ। কেউ কবিতার বই পড়তে ভালোবাসেন, আবার কেউবা গল্প-উপন্যাস, কেউ নাটক পেলে অন্যকিছু চান না, কেউ কেউ আবার ভ্রমণকাহিনী ভালোবাসেন। এছাড়া, কারো প্রিয় দর্শন, কারো-বা ইতিহাস, কেউ খোঁজেন লোকপ্রশাসন-বিষয়ক বই, আবার কেউ কেউ পদার্থ, রসায়ন ও প্রাণিবিজ্ঞান। কেউ কেউ দেশের ইতিহাস, অর্থনীতি, সমাজনীতি ইত্যাদি সম্পর্কে নতুন তথ্য খুঁজে বের করবেন বলে অনুসন্ধিৎসু। তাঁরা দলিল-দস্তাবেজ, বিবর্ণ প্রাচীন পুঁথি এবং অতীত যুগের পত্রিকা ইত্যাদি থেকে বের করেন নিজের চাহিদার খোরাক। তাই গ্রন্থাগারের নানাবিধ প্রয়োজনীয়তায় সমাজের মানুষ নানাভাবে উপকৃত হয়ে থাকে। তবে সুষ্ঠুভাবে গ্রন্থ সংগ্রহ অতি-দুরূহ কাজ। প্রতিদিন দেশ-বিদেশে হাজার হাজার নতুন গ্রন্থ প্রকাশিত হচ্ছে। গ্রন্থাগারের সঙ্গতি ও প্রয়োজনের দিকে লক্ষ্য রেখে উৎকৃষ্ট গ্রন্থকেই সংগ্রহের জন্য নির্বাচন করা শ্রেয়। আবার শুধুমাত্র সংগ্রহ করলেই গ্রন্থাগারের দায়িত্ব শেষ হয় না, সংগৃহীত গ্রন্থগুলো যাতে সযত্নে থাকে সেদিকেও লক্ষ্য রাখা বাঞ্ছনীয়। নানাবিধ পোকার উপদ্রবে, প্রাকৃতিক বাধা-বিপত্তিতে এবং অসৎ পাঠক ও গ্রন্থাগার কর্মীদের দায়িত্বজ্ঞানহীনতায় অনেক সময় বহু উৎকৃষ্ট গ্রন্থ বিনষ্ট হয়। ঐ সব সংগৃহীত গ্রন্থগুলো দেশ ও জাতির অমূল্য সম্পদ, গ্রন্থাগারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকলেরই এই কথা মনে রাখা উচিত।

বাংলাদেশে গ্রন্থাগার : বাংলাদেশে ১৯৫৩ সালে ঢাকায় কেন্দ্রীয় পাবলিক লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠিত হয়। এই লাইব্রেরির সহযোগিতায় এখন দেশের বিভিন্ন এলাকায় শতাধিক সরকারি ও বেসরকারি গ্রন্থাগার পরিচালিত হচ্ছে। বিদেশি দূতাবাসের সহায়তায় যেসব লাইব্রেরি আমাদের দেশে গড়ে উঠেছে, তার মধ্যে ব্রিটিশ কাউন্সিল লাইব্রেরি অন্যতম। বর্তমানে দেশে ৬৮টি সরকারি, ৮৮৩টি বেসরকারি এবং গণ-উন্নয়ন পাঠাগারের অধীনে ২৭টি গ্রন্থাগার সক্রিয়ভাবে পরিচালিত হচ্ছে।

উপসংহার : বর্তমানে জ্ঞান-বিজ্ঞানে উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে গ্রন্থাগারের জনপ্রিয়তা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। পৃথিবীর বিভিন্ন অগ্রসর ও উন্নয়নশীল দেশে গড়ে উঠেছে নানা ধরনের গ্রন্থাগার। আমাদের বাংলাদেশ এর ব্যতিক্রম নয়। স্বাধীনতা প্রাপ্তির পর এ দেশের গ্রন্থাগারের সংখ্যা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। শিক্ষিত জনসাধারণের মধ্যে গ্রন্থাগার সম্পর্কে নতুন আগ্রহের সৃষ্টি হয়েছে। আমাদের দেশের পাবলিক লাইব্রেরি, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র, বাংলা একাডেমী গ্রন্থাগার জনগণের গ্রন্থপাঠের প্রয়োজন মেটাচ্ছে।

গ্রন্থাগার রচনা ২

ভূমিকা:

যুগ-যুগান্তরের অগণিত মানুষের ভাবৈশ্বর্যের এক অফুরন্ত ভাণ্ডার হলাে গ্রন্থাগার জ্ঞানপিপাসু মানুষের অকৃত্রিম বন্ধু এ গ্রন্থাগার। শত শতাব্দীর মনীষীদের ভাব ও জ্ঞানের ডালি সাজিয়ে গ্রন্থাগার নিঃশব্দে আমন্ত্রণ জানিয়ে চলেছে বিশ্বমানকে। কালের প্রবাহে মানুষ আসে, আবার চলেও যায়। কিন্তু তার ধ্যানধারণা, অভিজ্ঞতা, চিন্তাভাবনা সে লিপিবদ্ধ
করে যায় বইয়ে গ্রন্থাগার সে বই সংরক্ষণ করে এবং পরবর্তী প্রজন্মের সাথে হারিয়ে যাওয়া প্রজন্মের পরিচয় ঘটিয়ে দেয়।

গ্রন্থাগার কী:

গ্রন্থাগার বিচিত্র জ্ঞানের, বিচিত্র ভাবের শাশ্বত ভাণ্ডার মানুষের চিন্তার অমূল্য সম্পদ গ্রন্থাগারে সঞিত থাকে। সভ্যতার সূচনা লগ্নের মানবহৃদয়ের কলতান যেমন এখানে সঞ্চিত থাকে, তেমনি সঞ্চিত থাকে বর্তমান মানবহৃদয়ের উত্থান-পতন। তাই গ্রন্থাগার রচনা করে অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যতের সেতুবন্ধন । রবীন্দ্রনাথের ভাষায়—

‘কে জানিত মানুষ
অতীতকে বর্তমানে বন্দি করিবে? অতলস্পর্শ কালসমুদ্রের ওপর কেবল এক একখানি বই দিয়া সাঁকো বাধিয়া দিবে ।’

গ্রন্থাগার ভাব তৃষিত ও জ্ঞানপিপাসু মানুষুের হৃদয় ও মনের ক্ষুধা দূর করার অসাধারণ ও বিপুল আয়ােজন। যেখানে এসে এক হৃদয়ের নীরব সান্নিধ্যে অন্য হৃদয় পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে।

গ্রন্থাগার নবজাগরণের উৎস:

গ্রন্থাগার কালের নীরব সাক্ষী। তাতে বন্দি হয়ে আছে কত ভাবুক কত মনীষীর ভাব-চিন্তা, দেশবিদেশের কত ঘটনাপ্রবাহ, কত বিপ্লব ও সামাজিক অগ্রগতির ইতিহাস। যা মানবহৃদয়ে প্রেরণার সার করে, দেয়। পথনির্দেশনা, গ্রন্থাগারের মাধ্যমেই পাওয়া যায় নবসৃষ্টির উদ্দীপনা, নানা দুরূহ জিজ্ঞাসার উত্তর শত শত মনীষীর ভাব-চিন্তার সার ঘটিয়ে, ইতিহাসের নানামুখী ঘটনার সাথে পরিচয় ঘটিয়ে গ্রন্থাগার নবজাগরণে উদ্দীপ্ত করে মানবহৃদয়কে, পরিচালিত করে এক নতুন প্রভাতের অভিমুখে।

গ্রন্থাগারের উদ্ভব:

গ্রন্থাগারের ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায়, প্রাচীন রোমান সম্রাট জুলিয়াস সিজার প্রথম এই ধারণা দেন। তাঁর নির্দেশে মার্কাস নামের একজন লেখক গ্রন্থাগার নিয়ে একটি গবেষণাগ্রন্থ রচনা করেন। এর পাঁচ বছর পর একটি গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠিত হয়। তবে এরও আগে গ্রন্থাগারের নিদর্শন পাওয়া যায়। প্রায় সাড়ে চার হাজার বছর আগে ব্যাবিলনের নিপ্পর শহরের এক মন্দিরে এমন নিদর্শনের সন্ধান মেলে। এছাড়া অ্যাসিরিয়ার রাজা আশুরবানিপালের গ্রন্থাগারেও পোড়ামাটির ফলকে লেখা বহু প্রাচীন গ্রন্থ পাওয়া গেছে। তবে খ্রিস্টপূর্ব ৪০০ সালের দিকে গ্রিক শাসক টলেমি যে গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা করেন, সেটিকে প্রাচীনকালের সবচেয়ে বড় গ্রন্থাগার বলা হয়। শুরুতে যাঁরা গ্রন্থাগার তৈরি করেছিলেন, তাঁরা সবাই ছিলেন রাজা, শাসক বা প্রশাসক—দিগ্বিজয়ী ব্যক্তি।

গ্রন্থাগারের অতীত ও বর্তমান অবস্থা:

জ্ঞানপিপাসা মানবহৃদয়ের এক স্বাভাবিক ও শাশ্বত বৈশিষ্ট্য। মানবহৃদয়ের অদম্য জ্ঞানপিপাসার তাগিদেই শুরু হয় জ্ঞানচর্চা। জ্ঞানচর্চার পথ ধরেই রচিত হলাে গ্রন্থ। মানুষের চিন্তার অনন্য প্রকাশ এ গ্রন্থগুলােকে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে পৌছে দেয়ার তাগিদ অনুভব করে বিদ্যানুরাগী মানুষ প্রবর্তন করেন গ্রন্থাগারের। সভ্যতার সূচনালগ্ন থেকেই স্বনামধন্য ব্যক্তিগণ অত্যন্ত যত্ন সহকারে গ্রন্থ সংরক্ষণে ভূমিকা রাখেন। ব্যাবিলন, আসিরিয়া, আলেকজান্দ্রিয়া, নালন্দা, তক্ষশীলা ও বিক্রমশীলা প্রভৃতি স্থানে প্রাপ্ত গ্রন্থাগার তাদের উন্নত মানসিকতারই পরিচয় বহন করে। অথচ মধ্যযুগে এসে দেখা গেল বিজেতা জাতি বিজিতের গ্রন্থাগারের ধ্বংস সাধনে ব্যস্ত । উদ্দেশ্য বিজিতের ধর্ম ও সংস্কৃতিকে ধ্বংস করা। এ হিংসােন্মুখ মানসিকতায় ভস্মীভূত হয়েছে বহু বছরের সংগৃহীত অমূল্য সম্পদ। যেমন— ধ্বংস হয়েছে আলেকজান্দ্রিয়ার সুবিশাল গ্রন্থাগার, বাগদাদে বায়তুল হিকমাহ গ্রন্থাগার। বর্তমানে গ্রন্থাগার মানুষের কাছে অত্যন্ত সুপরিচিত একটি নাম। সরকারি, বেসরকারি উদ্যোগে পরিচালিত হয় গ্রন্থাগার। আধুনিক মানুষ তাদের প্রাত্যহিকতার একটি অনুষঙ্গ হিসেবেই গ্রন্থাগারকে মূল্যায়ন করে। কিন্তু আজও স্বার্থান্বেষী মহলের হিংসাবহ্নি থেকে গ্রন্থাগার রেহাই পায় না। অতি সম্প্রতি আমেরিকা তাদের বর্বরতায় ধ্বংস করল ইরাকের ঐতিহ্য ও মূল্যবান গ্রন্থাগার। তবে এটা ঠিক যে, সচেতন জ্ঞানানুরাগী মানুষের মনে গ্রন্থাগার এক অমূল্য অবস্থান নিয়েছে প্রাচীনকালে বিদ্যানুরাগী মানুষ জ্ঞানপিপাসা মেটানাের জন্য ছুটে যেতেন দেশ হতে দেশান্তরে। আর বর্তমানে গ্রন্থাগার সে কষ্ট দূর করে বিশ্বের জ্ঞানভাণ্ডারকে আমাদের হাতে পৌছে দিয়েছে।

গ্রন্থাগারের শ্রেণিবিভাগ:

গ্রন্থের সংগ্রহশালাই হলো গ্রন্থাগার। এটি কখনো ব্যক্তিগত হতে পারে, আবার কখনো রাষ্ট্রীয়ভাবে পরিচালিত হতে পারে। ব্যক্তিগত গ্রন্থাগারে একজন ব্যক্তি নিজের রুচি ও প্রয়োজন অনুযায়ী বই সংগ্রহ করেন। আর রাষ্ট্রীয় গ্রন্থাগার সবার জন্য উন্মুক্ত থাকে, তাই সেখানে সাধারণ মানুষের পছন্দ-অপছন্দকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। সাধারণত ব্যক্তিগত গ্রন্থাগারে বইয়ের সংখ্যা কম থাকে, কিন্তু রাষ্ট্রীয় বা সরকারি গ্রন্থাগারে বইয়ের সংখ্যা অনেক বেশি হয়। এ ছাড়া স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়েও গ্রন্থাগার থাকে। অনেক সময় বেসরকারি উদ্যোগেও গ্রন্থাগার গড়ে ওঠে, যেগুলো সাধারণ গ্রন্থাগার হিসেবেই পরিচিত।

গ্রন্থাগারের গুরুত্ব:

গ্রন্থাগারে এক সঙ্গে বিচিত্র বইয়ের সমাবেশ ঘটে। বিচিত্র ভাব, বিচিত্র চিন্তা, বিচিত্র অভিজ্ঞতার অফুরন্ত উৎস ভাণ্ডার গ্রন্থাগার । তাই জ্ঞানান্বেষী মানুষ আপন মনের খােরাক সহজেই এখানে খুঁজে পায়। জীবনসংগ্রামে লিপ্ত ক্লান্ত মানুষ গ্রন্থের এ বিচিত্র আয়ােজনে খুঁজে পায় এক অনির্বচনীয় আনন্দপূর্ণ প্রাণস্পন্দন। ‘ঐকতান’ কবিতায় রবীন্দ্রনাথ আপন জ্ঞানের অপূর্ণতার কথা বলেছেন এভাবে-

‘বিপুলা এ পৃথিবীর কতটুকু জানি!
দেশে দেশে কত না নগর রাজধানী
মানুষের কত কীর্তি, কত নদী গিরি সিন্ধু মরু,
কত না অজানা জীব, কত না অপরিচিত তরু
রয়ে গেল অগােচরে। বিশাল বিশ্বের আয়ােজন;
মন মাের জুড়ে থাকে অতি ক্ষুদ্র তারি এক কোণ।

মানুষের জ্ঞানের এ অপূর্ণতাকে পূর্ণতায় ভরিয়ে দিতে পারে বই। দেশ-বিদেশের হাজার হাজার মনীষীর অমূল্য গ্রন্থে গ্রন্থাগার সমৃদ্ধ। তাই মানুষের অনুসন্ধিৎসু মন গ্রন্থাগারে এসে খুঁজে পায় কাঙ্ক্ষিত খােরাক। একই ব্যক্তির পক্ষে চাহিদা অনুযায়ী সকল বই কেনা সম্ভব হয় না। এক্ষেত্রে গ্রন্থাগারই তার ভরসাকেন্দ্র। ফলে মানুষের জানার ভাণ্ডারকে পূর্ণ করতে গ্রন্থাগারের গুরুত্ব অপরিসীম। একটি জাতিকে উন্নত, শিক্ষিত ও সংস্কৃতিবান হিসেবে গড়ে তােলার ক্ষেত্রে গ্রন্থাগার উল্লেখযােগ্য ভূমিকা রাখে। তাছাড়া বিভিন্ন বয়সের পাঠক গ্রন্থাগারে একত্রে পাঠগ্রহণ করে বলে তাদের মধ্যে গড়ে ওঠে আন্তরিকতা, একতা, এক্ষেত্রে বিচারপতি ও লেখক মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের উক্তি প্রণিধানযােগ্য গ্রন্থাগারের মাধ্যমে মানুষের মধ্যে গড়ে ওঠে সংহতি যা দেশগড়া কিংবা রক্ষার কাজে রাখে অমূল্য অবদান। সুতরাং,

ব্যক্তিগত ও জাতীয় জীবনে
গ্রন্থাগারের প্রয়ােজনীয়তা অনস্বীকার্য।

ছাত্রজীবনে গ্রন্থাগারের ভূমিকা:

প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা একজন ছাত্রকে জ্ঞানের একটি নির্দিষ্ট পর্যায় পর্যন্ত নিয়ে যায়, আর গ্রন্থাগার তাকে নতুন নতুন জ্ঞানের দরজা দেখায়। শ্রেণিকক্ষের সীমিত পরিসরে যে জ্ঞান অর্জিত হয়, গ্রন্থাগার তা আরও সমৃদ্ধ করে তোলে। তাই ছাত্রজীবনে গ্রন্থাগারের গুরুত্ব অনেক বেশি। এখানে ছাত্ররা তাদের নানা প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পায় এবং শত শত মনীষীর চিন্তা ও দর্শন থেকে অনুপ্রেরণা গ্রহণ করে। এই জ্ঞান ও প্রেরণা তাদেরকে জীবন গঠনে সাহায্য করে এবং দেশের উন্নয়নে অবদান রাখার উৎসাহ জোগায়।

অতীত ও বর্তমানের বিখ্যাত গ্রন্থাগার:

প্রাচীন যুগের বিখ্যাত গ্রন্থাগারের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য হলাে মিশরের আলেকজান্দ্রিয়া জাদুঘর। বর্তমানে পৃথিবীর বিখ্যাত গ্রন্থাগারের মধ্যে উল্পেখযােগ্য হলাে ব্রিটেনের ব্রিটিশ মিউজিয়াম, মস্কোর লেনিন লাইব্রেরি, ফ্রান্সের বিবলিওথিক ন্যাশনাল লাইব্রেরি, আমেরিকার লাইব্রেরি অব কংগ্রেস, কলকাতার ন্যাশনাল লাইব্রেরি ইত্যাদি।

বাংলাদেশের গ্রন্থাগার:

আমাদের দেশে শিক্ষার প্রসারের সাথে সাথে গ্রন্থাগারের প্রসারও বেড়েছে। ১৯৫৩ সালে ঢাকায়। প্রতিষ্ঠিত হয় কেন্দ্রীয় পাবলিক লাইব্রেরি । এ লাইব্রেরির সহযােগিতায় শতাধিক সরকারি ও বেসরকারি গ্রন্থাগার দেশের বিভিন্ন স্থানে পরিচালিত হচ্ছে। বর্তমানে আমাদের দেশে সরকারি গ্রন্থাগারের সংখ্যা ৬৮টি এবং বেসরকারি গ্রন্থাগারের সংখ্যা ৮৮৩টি। তাছাড়া গণ-উন্নয়ন পাঠাগারের পরিচালনায় রয়েছে ২৭টি গ্রন্থাগার । বিদেশি দূতাবাসের আনুকুল্যে এদেশে পরিচালিত লাইব্রেরির মধ্যে ব্রিটিশ কাউন্সিল লাইব্রেরি বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য।

উপসংহার:

গ্রন্থাগার বহু মানুষের সম্মিলিত প্রতিষ্ঠান। বিশ্বের জ্ঞানপিপাসু মানুষের ভাব মিলনকেন্দ্র গ্রন্থাগার। কোনাে জাতির আত্রিক পরিচয়, হৃদয়ের স্পন্দন, জ্ঞানের গভীরতা সংগৃহীত থাকে এখানে। তাই জাতির ইতিহাস জেনে জাতিকে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিতে সাহায্য করে গ্রন্থাগার । তাই অজ্ঞানতার অভিশাপ থেকে জাতিকে মুক্ত করতে হলে, সমৃদ্ধ করতে হলে গ্রন্থাগারের প্রসার বাড়াতে হবে। গ্রন্থাগার আন্দোলনকে শহর থেকে নিয়ে যেতে হবে গ্রামে । তবেই জাতীয় জীবনে আসবে কাক্ষিত সফলতা

উপসংহার: আপনি যদি এই রচনাটি ভালো মনে করেন, তাহলে আমাদের ওয়েবসাইটে আরও রচনা পড়ে দেখতে পারেন। অনেক সুন্দর ও সহজ রচনা আছে — শুধু StudyTika.com-এ।

Getting Info...

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Oops!
It seems there is something wrong with your internet connection. Please connect to the internet and start browsing again.