রসুন, আমাদের রান্নার অঙ্গীকার, শুধু খাবারের স্বাদ বাড়ায় না, বরং অসংখ্য স্বাস্থ্য উপকারিতাও রয়েছে। প্রাচীনকাল থেকেই এটি নানা রোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়ে আসছে।
আজ আমরা জানবো রসুনের এমন কিছু গুণের কথা, যা আপনার স্বাস্থ্যকে সুন্দর করে তুলতে পারে। চলুন, রসুনের গুণাগুণ নিয়ে একটু আলোচনা করি।
রসুন এর উপকারিতা
রসুন হলো একটি মসলাজাতীয় উপাদান, যার ঘ্রান তীব্র এবং ঝাঁজালো। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে রসুন একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। রান্নার কাজে আমরা রসুন ব্যবহার করে থাকি। কিন্তু প্রাচীন যুগে ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায় যে রোগ থেকে বাঁচার জন্য তারা রসুন ব্যবহার করতো। বিশেষ করে গ্রিস, ব্যাবিলনীয়, মিশরীয়, রোমান ও চৈনিকরা রসুনকে ঔষধ হিসেবে ব্যবহার করতো।
রসুনে আছে সেলেনিয়াম, থায়ামিন, ফোলেট, নায়াসিন ও প্যান্টোথেনিক এসিড। এছাড়াও রসুনে এলিসিন নামে একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান রয়েছে, যা থাকার কারণে আমাদের শরীরে ক্যান্সার ও শারীরিক সমস্যা প্রতিরোধ করে। এর জন্য রসুনকে সুপারফুডে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
রসুন খাওয়ার উপকারিতা
রসুন খাওয়ার নিয়ম:
- পুষ্টিবিদরা বলেছেন পূর্ণবয়স্কদের ২/৩টি রসুনের কোয়া খেতে।
- রসুন পানিতে ভিজিয়ে সে পানি খেতে পারবেন।
- প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে খালি পেটে এক কোয়া রসুন চিবিয়ে খেলে অনেক উপকার হয়।
- সকালে খালি পেটে ১/২ কোয়া কাঁচা রসুন খেতে হবে। (কাঁচা রসুন খাওয়া সবচেয়ে উপকার)
- রান্নার সাথে রসুন কুঁচি কুঁচি করে দিয়ে খেতে হবে। (রান্নার সাথে খেলে রসুনের গুণাগুণ কিছুটা নষ্ট হয়)।
- রসুনের আচার বানিয়ে খেতে পারেন।
- সিদ্ধ করে খেতে পারেন।
- রসুন ঘি এ ভেজে গরম ভাতের সাথে খাওয়া যায়।
ত্বকে রসুনের উপকারিতা
বর্তমানে আমাদের দেশের বয়সের ছেলে মেয়েদের প্রায় সবার ব্রণের সমস্যা। এই ব্রণ থেকে বাঁচতে ছেলে মেয়েরা বিভিন্ন রকমের ক্রিম ব্যবহার করে, যা ত্বকের জন্য খুবই ক্ষতিকর। এই ক্রিম ব্যবহার করার কারণে ত্বকে ক্যান্সার হয়। মুখের ব্রণ দূর করতে আমরা ক্রিম ব্যবহার না করে রসুন ব্যবহার করতে পারি। কারণ মুখের ব্রণ দূর করতে রসুন একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে কাজ করে।
মুখে রসুন ব্যবহার করার পদ্ধতি:
- রসুন নিয়ে ব্লেন্ডার বা ছেঁচে রস বের করে সে রস মুখে লাগান। পাঁচ মিনিট পর মুখ ধুয়ে ফেলুন।
- এইভাবে আপনি নিয়মিত কয়েকদিন (৭-১৫দিন) ব্যবহার করলে মুখের ব্রণ ও লালচে ভাব দূর হয়ে যাবে।
- মুখের পসমের (লোমকূপ) গোঁড়ায় ময়লা জমে ব্রণ ও কালো দাগ হয়ে থাকে। এর থেকে মুক্তি পেতে রসুন ব্যবহার করতে পারেন।
- রসুনের সাথে টমেটু নিয়ে ব্লেন্ডার করে পেস্ট তৈরি করুন। এই পেস্ট মুখে লাগান এবং ১০/১২ মিনিট পর ধুয়ে ফেলুন।
অনেক সময় দেখা যায় যে বয়স কম কিন্তু বেশি বয়স মনে হয়। প্রতিদিন রসুন চিবিয়ে খেলে অতিরিক্ত বয়সের ছাপ ও ওজন কমে যায়। আজকাল এলার্জি সমস্যা প্রায় সবার। এলার্জি কারণে শরীরে লাল দাগ পড়ে। লাল জায়গায় রসুনের রস লাগিয়ে ম্যাসাজ করলে লাল দাগ ও জ্বালাপোড়া কমবে।
চুলে রসুনের উপকারিতা
রসুনে রয়েছে এক ধরনের অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, সালফার, ক্যালসিয়াম ও জিঙ্ক, যা মাথার চুল পড়া বন্ধ করে। রসুনে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন থাকার কারণে নতুন চুল গজাতে সাহায্য করে।
কিভাবে চুলে রসুন ব্যবহার করবেন:
- প্রথমে ৭/৮ কোয়া রসুন ও এক টেবিল চামচ মধু নিন। তারপর রসুনের রস বের করে মধুর সাথে ভালো করে মিশিয়ে নিন। মিশ্রণটি ভালোভাবে চুলের গেড়ায় দিয়ে ১৫/২০ মিনিট রাখুন। পরে স্যাম্পু দিয়ে মাথা ধুয়ে ফেলুন। এই মিশ্রণটি একদিন পরপর ব্যবহার করুন।
- আরেকটি নিয়ম হলো, প্রথমে ৭/৮ কোয়া রসুন ও একটি পিয়াজ নিয়ে ব্লেন্ডার দিয়ে পেস্ট তৈরি করুন। তারপর আধা টেবিল চামচ অলিভ অয়েল গরম করুন। অলিভ অয়েলের সাথে রসুন ও পিয়াজের পেস্ট মিশিয়ে গরম করুন (যতক্ষণ পযন্ত বাদামী রঙ ধারণ না করে)। এর পর চুলা থেকে নামিয়ে ঠান্ডা করুন। ঠান্ডা হওয়ার পর মাথায় লাগান। মাথায় দিয়ে ৩০/৩৫ মিনিট রাখার পর স্যাম্পু দিয়ে মাথা ধুয়ে ফেলুন। এইভাবে নিয়মিত একদিন পরপর ব্যবহার করুন।
রসুন রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে
আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমলে প্রায়ই জ্বর, কাশি ও ঠান্ডা ইত্যাদি রোগে আক্রান্ত হই। আমরা ঘরোয়া পরিবেশে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে পারি। এটা হচ্ছে রসুন ও মধুর মিশ্রণ।
রসুনে আছে এলিসিন। এলিসিন বিপাক কার্যক্রম ভালো করে ও দ্রুত ওজন কমায়। রসুন রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
মধুতে আছে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, যা শরীরের কোষকে শক্তিশালী করে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে।
কাঁচা রসুণের উপকারিতা
রসুন আমাদের শরীরে বিভিন্ন রকমের রোগ প্রতিরোধ করে। কাঁচা রসুন খেলে আমাদের শরীরের জন্য বেশি উপকার হয়। পুষ্টিবিদরা বলেছেন সকালে ঘুম থেকে উঠে প্রতিদিন নিয়মিত এক কোয়া রসুন খেলে বিভিন্ন রোগ থেকে বাঁচা যায়।
কাঁচা রসুণের উপকারিতাসমূহ:
- ঠান্ডা থেকে বাঁচা যায়: সকালে ঘুম থেকে উঠে খালি পেটে এক কোয়া রসুন দুই বা তিন সপ্তাহ নিয়মিত খেলে ঠান্ডা থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে।
- শরীরের বিভিন্ন ক্ষতিকর উপাদান বের করে দেয়: সকালে ঘুম থেকে উঠে খালি পেটে এক কোয়া রসুন খেলে শরীরের বিষাক্ত উপাদান মূত্রের মাধ্যমে বের হয়।
- রক্ত পরিষ্কার রাখে: রসুনে আছে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, যা রক্ত পরিষ্কার ও রক্তের শর্করার পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করে।
- হৃদরোগ থেকে বাঁচতে: নিয়মিত খালি পেটে রসুন খেলে হৃদযন্ত্র ভালো থাকে।
রসুন বয়স্ক নারীদের জন্য অনেক উপকার
মহিলাদের বয়স বাড়ার সাথে সাথে তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায় এবং হাড় দুর্বল হয়ে যায়। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমার কারণে তারা বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে যায়। তাই প্রতিদিন বয়স্ক মহিলাদের ২ গ্রাম করে রসুন খাওয়া দরকার।
রসুন খেলে বয়স্ক মহিলাদের ইস্ট্রোজেন হরমোন বৃদ্ধি পায়, ফলে হাড়ের দুর্বলতা কমে যায়।
রসুনের পুষ্টি উপাদান (প্রতি ১ কোয়া বা প্রায় ৩ গ্রাম)
পুষ্টি উপাদান | পরিমাণ | দৈনিক প্রয়োজনীয়তার শতকরা হার |
---|---|---|
ক্যালরি | ৫ কিলোক্যালরি | – |
মোট কার্বোহাইড্রেট | ১ গ্রাম | – |
ডায়েটারি ফাইবার | ০.১ গ্রাম | – |
প্রোটিন | ০.২ গ্রাম | – |
ম্যাঙ্গানিজ | ০.০৬ মিলিগ্রাম | ৩% |
ভিটামিন বি৬ | ০.০৪ মিলিগ্রাম | ২% |
ভিটামিন সি | ০.৯ মিলিগ্রাম | ১% |
ক্যালসিয়াম | ৫ মিলিগ্রাম | ১% |
বিশেষ দ্রষ্টব্য: দৈনিক প্রয়োজনীয়তার শতকরা হার একটি ২০০০ ক্যালরি ডায়েটের উপর ভিত্তি করে তৈরি।
রসুনে অ্যালিসিন নামে একটি যৌগ রয়েছে, যা রসুনের অনেক স্বাস্থ্য উপকারিতার সাথে যুক্ত। সামান্য পরিমাণে রসুনে অন্যান্য ভিটামিন এবং খনিজ পদার্থও রয়েছে।
রসুনের অপকারিতা
রসুনের যেমন উপকার আছে, তেমন কিছু ক্ষতিকর দিকও আছে:
- খালি পেটে রসুন খেলে কিছু কিছু লোকের ডায়রিয়া হয়ে যায়।
- গর্ভধারণ মহিলারা অতিরিক্ত রসুন খেলে প্রসব বেদনা বেড়ে যায় এবং রক্তক্ষরণ হয়।
- যেসকল মায়েদের বাচ্চা দুধ খায়, ঐসব মায়েরা রসুন খেলে দুধের স্বাদ পরিবর্তন হয়।
- অতিরিক্ত রসুন খেলে রক্তের ঘনত্ব কমে যায়। যারা অ্যাসফিরিন, ওয়ারফিরিন ইত্যাদি ঔষধ খেয়ে থাকেন, তারা অতিরিক্ত রসুন খেলে রক্তের ঘনত্ব পাতলা হয়ে যায়।
- এক গবেষণায় দেখা গেছে যে অতিরিক্ত রসুন খেলে রক্তচাপ কমে যেতে পারে এবং শরীরের ঘাম বেশি বের হয়।
- যুক্তরাষ্ট্রের একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ন্যাশনাল ক্যান্সার ইনস্টিটিউটের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, খালি পেটে রসুন খেলে বমিভাব, বমি ও বুকজালাপোড়া হতে পারে।