জান্নাত লাভ ও জাহান্নাম থেকে মুক্তির দোয়াঃ জান্নাত একটি আরবি শব্দ, যার অর্থ হলো বাগান। ইসলামি পরিভাষায়, আখিরাতে আল্লাহ মুমিনদের জন্য যে নেয়ামতপূর্ণ স্থান প্রস্তুত করেছেন, তা জান্নাত হিসেবে পরিচিত। জান্নাতের স্তর মোট আটটি এবং এটি ফারসি ভাষায় বেহেশত নামেও পরিচিত। জান্নাত লাভের জন্য মুসলিমদের অন্যতম প্রধান আকাঙ্ক্ষা হল, জাহান্নাম থেকে মুক্তি পেয়ে জান্নাতে প্রবেশ করা।
জাহান্নামও একটি আরবি শব্দ, যার অর্থ গভীর গর্ত। ইসলামের দৃষ্টিতে, আল্লাহ আখিরাতে অবিশ্বাসী এবং পাপীদের শাস্তি দেওয়ার জন্য যে ভয়াবহ অগ্নিময় স্থান তৈরি করেছেন, তাকে জাহান্নাম বলা হয়। পবিত্র কোরআন এবং হাদিসে এটিকে ‘নার’ (অগ্নি) নামেও আখ্যায়িত করা হয়েছে।
জাহান্নামের শাস্তি
মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনে বলেছেন, ‘আমি জালেমদের জন্য মহা অগ্নিময় স্থান প্রস্তুত করেছি, যার শিখা চারদিক থেকে তাদের ঘিরে তাদের শাস্তি দেবে। তারা যখন পানির জন্য চিৎকার করবে, তখন তেলের গাদার মতো গরম পানি তাদের খেতে দেওয়া হবে, যা তাদের মুখ পুড়িয়ে কয়লা করে ফেলবে। হায়! কী নিকৃষ্ট সে পানি, কী নিকৃষ্ট সেই আবাসস্থল!’ (সুরা কাহাফ, আয়াত: ২৯)
মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘মানুষকে সবচেয়ে বেশি জান্নাতে নেবে আল্লাহর ভয় এবং সুন্দর চরিত্র। আর মানুষকে সবচেয়ে বেশি জাহান্নামে নেবে মুখ ও লজ্জাস্থান।’ (তিরমিজি: ২০০৪)
জান্নাত লাভের দোয়া
দোয়া একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। আল্লাহর কাছে দোয়া না করলে, আল্লাহ অপছন্দ করেন। দোয়ার মাধ্যমে আমরা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারি এবং আমাদের সব ধরনের সমস্যা ও বিপদ থেকে মুক্তি পেতে পারি। নিচে জান্নাত লাভের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ দোয়া প্রদান করা হলো:
দোয়া: اللهم اني اسالك الجنة واعوذ بك من النار
উচ্চারণ: ‘আল্লাহুম্মা ইন্নি আসআলুকাল জান্নাহ, ওয়া আউযুবিকা মিনান্নার।’
অর্থ: ‘হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে জান্নাত কামনা করছি এবং জাহান্নাম থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করছি।’ (তিরমিজি: ২৫৭২)
জাহান্নাম থেকে মুক্তির দোয়া
জাহান্নাম থেকে বাঁচার জন্য আল্লাহ তাঁর বান্দাদের বিভিন্ন দোয়া শিখিয়েছেন। ইসলামিক শিক্ষা অনুসারে, ঈমান এবং নেক আমল, ফরজ পালন, পাপ বর্জন, তাক্বওয়া অর্জন এবং দোয়া করলেই আমরা জাহান্নাম থেকে মুক্তি লাভ করতে পারি।
দোয়া: رَبَّنَا آتِنَا فِي الدُّنْيَا حَسَنَةً وَفِي الْآخِرَةِ حَسَنَةً وَقِنَا عَذَابَ النَّارِ
উচ্চারণ: ‘রব্বানা আতিনা ফি দুনিয়া হাসানাহ ওয়া ফি আখিরাত হাসানাহ, ওয়া কিনা আযাবান নার।’
অর্থ: ‘হে আমাদের প্রভু! আমাদেরকে দুনিয়ায় কল্যাণ দাও এবং আখিরাতে কল্যাণ দাও, এবং আমাদের জাহান্নামের শাস্তি থেকে রক্ষা কর।’ (সুরা বাকারা, আয়াত: ২০১)
দোয়া: اللَّهُمَّ رَبَّ جِبْرَائِيلَ وَمِيكَائِيلَ وَرَبَّ إِسْرَافِيلَ أَعُوذُ بِكَ مِنْ حَرِّ النَّارِ وَمِنْ عَذَابِ الْقَبْرِ
উচ্চারণ: ‘আল্লাহুম্মা রব্বা জিবরাইল, মিকাইল, এবং ইস্রাফিল! আমি আপনার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করছি জাহান্নামের উত্তাপ ও কবরের শাস্তি থেকে।’ (নাসায়ী: ৫৫১৯)
জাহান্নাম থেকে মুক্তির জন্য আরও কিছু দোয়া ও আমল
রাসূলুল্লাহ (সা.) আরো অনেক দোয়া এবং আমল শিখিয়েছেন, যা জাহান্নাম থেকে মুক্তি লাভে সাহায্য করে। এর মধ্যে অন্যতম একটি হলো:
এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে গিয়ে বললেন, ‘হে আল্লাহর রসুল! আপনি আমাকে এমন একটি আমল বলুন, যা আমাকে জান্নাতে নিয়ে যাবে এবং জাহান্নাম থেকে মুক্তি দিবে।’
রাসূল (সা.) বললেন, ‘তুমি আল্লাহর ইবাদত করবে, তার সঙ্গে কাউকে অংশীদার করবে না, নামাজ প্রতিষ্ঠা করবে, জাকাত দেবে এবং রক্তের সম্পর্ক বজায় রাখবে।’ (বুখারি ও মুসলিম)
জান্নাত লাভের সহজ দোয়া
হাদিসে জানা গেছে যে, ‘রাদিতু বিল্লাহি রব্বাউঁ ওয়া বিল ইসলামী দ্বিনাউঁ ওয়া বিমুহাম্মাদিন নাবিয়্যাঁও ওয়া রাসুলা’ এই দোয়া পড়লে জান্নাত ওয়াজিব হয়ে যায়।
দোয়া: رَضِيتُ بِاللَّهِ رَبًّا ، وَبِالْإِسْلَامِ دِينًا ، وَبِمُحَمَّدٍ رَسُولًا
উচ্চারণ: ‘রাদিতু বিল্লাহি রব্বাউঁ ওয়া বিল ইসলামী দ্বিনাউঁ ওয়া বিমুহাম্মাদিন নাবিয়্যাঁও ওয়া রাসুলা।’
অর্থ: ‘আমি আল্লাহকে রব, ইসলামকে দ্বিন এবং মুহাম্মদ (সা.)-কে রাসুল হিসেবে সন্তুষ্টচিত্তে মেনে নিয়েছি।’
আবু সাঈদ খুদরি (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি এই দোয়া পড়বে, তার জন্য জান্নাত ওয়াজিব হয়ে যাবে।’ (আবু দাউদ, হাদিস: ১৫২৯)
অন্য একটি হাদিসে মুনাইজির (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘যে ব্যক্তি সকালে এই দোয়া পড়বে, আমি তার হাত ধরে তাকে জান্নাতে নিয়ে যাবো।’ (মুজামুল কবির, হাদিস: ৩৫৫/২০)
এছাড়াও, যে ব্যক্তি সকাল ও বিকেল তিনবার এই দোয়া পড়বে, কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাকে নেকি দিয়ে সন্তুষ্ট করবেন। (তিরমিজি: ২/১৭৬)
জান্নাত লাভের আট আমল
জান্নাত লাভের আট আমল
জান্নাত একটি অতি পরিচিত শব্দ যা সাধারণত সুখময় স্থান বা বাগান হিসেবে পরিচিত। ইসলামের পরিভাষায় জান্নাত হচ্ছে সেই চিরস্থায়ী সুখী স্থান যা মুমিনদের জন্য আখিরাতে আল্লাহ তাআলা প্রস্তুত করেছেন। তবে জান্নাতে প্রবেশের জন্য কেবল ইচ্ছা বা সাধনা যথেষ্ট নয়; এর জন্য কোরআন ও সুন্নাহ অনুসরণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
কোরআনে আল্লাহ তাআলা বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের আনুগত্য করবে, আল্লাহ তাকে এমন জান্নাতে প্রবেশ করাবেন, যার তলদেশে প্রবহমান থাকবে নহর। আর যে ব্যক্তি তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে তাকে দেবেন যন্ত্রণাময় শাস্তি।’ (সুরা: ফাতহ, আয়াত: ১৭)
এখানে জান্নাত লাভের জন্য গুরুত্বপূর্ণ কিছু আমলের বর্ণনা দেয়া হলো:
১. পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়া
নামাজ ইসলাম ধর্মের অন্যতম প্রধান ইবাদত। কোরআন ও হাদিসে নামাজের গুরুত্ব বারবার উল্লেখ করা হয়েছে। নিয়মিত পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়লে আল্লাহ তাআলা জান্নাতে প্রবেশের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। উবাদা ইবনে সামিত (রা.)-এর বর্ণনায় রাসুল (সা.) বলেছেন, “যে ব্যক্তি এই নামাজগুলো যথাযথভাবে আদায় করবে, তার সঙ্গে আল্লাহ তাআলার চুক্তি হয়েছে যে তিনি তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন।” (আবু দাউদ, হাদিস: ১৪২০)
২. আয়াতুল কুরসি পাঠ করা
আয়াতুল কুরসি কোরআনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আয়াত। এটি কোরআনের আয়াতগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ মর্যাদার অধিকারী। আবু উমামা (রা.) থেকে বর্ণিত যে, রাসুল (সা.) বলেছেন, “যে ব্যক্তি প্রত্যেক ফরজ নামাজের পর আয়াতুল কুরসি পাঠ করবে, মৃত্যু ছাড়া জান্নাতে যাওয়ার পথে তার কোনো বাধা থাকবে না।” (নাসায়ী, হাদিস: ৯৮৪৮)
৩. সায়্যিদুল ইস্তেগফার পাঠ করা
সায়্যিদুল ইস্তেগফার হচ্ছে সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ ক্ষমা প্রার্থনা। এর পাঠের ফজিলত অনেক। রাসুল (সা.) বলেছেন, “যে ব্যক্তি দিনের বেলা সায়্যিদুল ইস্তেগফার পাঠ করবে, সে যদি সন্ধ্যা হওয়ার আগেই মারা যায়, সে জান্নাতি হবে।” (বুখারি, হাদিস: ৬৩০৬)
৪. কালেমা শাহাদাত পাঠ করা
কালেমা শাহাদাত একটি গুরুত্বপূর্ণ দোয়া যা অজু শেষে পড়া উত্তম। রাসুল (সা.) বলেন, “যে ব্যক্তি কামিল অজু করে ‘আশহাদু আল্লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়া আশহাদু আন্না মুহাম্মাদান আবদুহু ওয়া রাসুলুহু’ পাঠ করবে, তার জন্য জান্নাতের আটটি দরজা খুলে যাবে।” (মুসলিম, হাদিস: ৪৪৬)
৫. আজানের জবাব দেওয়া
আজান শুনে সঠিকভাবে জবাব দেয়া একটি সুন্নত, এবং এর বিনিময়ে জান্নাত প্রতিদান স্বরূপ। রাসুল (সা.) বলেছেন, “যে ব্যক্তি আজানের জবাব দিবে মনোযোগ সহকারে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।” (মুসলিম, হাদিস: ৩৮৫)
৬. বিশেষ তিনটি আমল
রাসুল (সা.) বলেছেন, “তোমরা সালামের প্রসার ঘটাও, খাবার খাওয়াও, এবং যখন মানুষ ঘুমিয়ে থাকে তখন তাহাজ্জুদ নামাজ পড়ো। তাহলে নিরাপদে জান্নাতে প্রবেশ করবে।” (তিরমিজি, হাদিস: ২৪৮৫)
৭. দুই জিনিসের হেফাজত করা
রাসুল (সা.) বলেন, “যে ব্যক্তি জিহ্বা ও লজ্জাস্থান হেফাজতের নিশ্চয়তা দেবে, আমি তার জন্য জান্নাতের দায়িত্ব নেব।” (বুখারি, হাদিস: ৬৪৭৪)
৮. আপনজনের মৃত্যুতে ধৈর্য ধারণ
প্রিয়জনের মৃত্যুতে ধৈর্য ধারণ করার প্রতিদান জান্নাত। রাসুল (সা.) বলেছেন, “আমি যখন আমার কোনো মুমিন বান্দার প্রিয়জনকে এই পৃথিবী থেকে নিয়ে যাই এবং সে ধৈর্য ধারণ করে, তার প্রতিদান জান্নাত।” (বুখারি)
এই আমলগুলো পালন করে একজন মুমিন জান্নাত লাভ করতে পারে, আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে এই আমলগুলো পালন করার তৌফিক দান করুন।
জান্নাতে বৃক্ষ রোপণ
জাবের (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি ‘সুবহানাল্লাহিল আজিম ওয়া বিহামদিহি’ এই দোয়া পাঠ করবে, তার জন্য জান্নাতে একটি খেজুরগাছ রোপণ করা হবে।’ (তিরমিজি: ৩৪৬৪)
Frequently Asked Questions (FAQ)
Frequently Asked Questions (FAQ)
শেষ কথা
এই পোস্টে জান্নাত লাভের জন্য বিভিন্ন আমল ও দোয়া সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। আশা করছি, আপনি এই নির্দেশনা গুলি অনুসরণ করবেন এবং আল্লাহর সাহায্যে জান্নাত লাভের পথে এগিয়ে যাবেন।
আরও শিক্ষণীয় এবং সহায়ক পোস্ট পড়তে আমাদের StudyTika.com ওয়েবসাইটে ভিজিট করুন। এখানে আপনি ইসলামিক শিক্ষা, জান্নাতের পথ এবং আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্পর্কে জানতে পারবেন।