বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচনা Class 7 8 9 10 ‍SSC HSC (২০+ পয়েন্ট)

এই ব্লগপোস্টে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিয়ে একটি সুন্দর রচনা দেওয়া হয়েছে। আশা করি, তোমরা মনোযোগ দিয়ে পুরো রচনাটি পড়বে।

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচনা Class 7 8 9 10 ‍SSC HSC (২০+ পয়েন্ট)

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচনা 

সূচনা

কবি-সাহিত্যিকরা একটি জাতিকে নানাভাবে নিজেদের লেখনী দ্বারা উপকৃত করেন। বাঙালি জাতির তেমনই একজন বিখ্যাত সাহিত্যিক হলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। বাঙালি মনীষার এক আশ্চর্য প্রকাশ কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। বিচিত্র ও বহুমুখী সাহিত্য প্রতিভার জন্য শুধু নয়, তাঁর ভাব, ভাষা, বিষয়বস্তুর গভীরতার জন্যও তিনি অনন্য। সত্য, সুন্দর কল্যাণ এই তিন বিশ্বজনীন বােধের ওপরই তার সমগ্র সৃষ্টিকর্ম প্রতিষ্ঠিত। বাংলা সাহিত্যের এমন কোনাে শাখা নেই যেখানে তার জাদুকরী প্রতিভার স্পর্শ লাগেনি। সুদীর্ঘ জীবনে সাহিত্য সাধনার পাশাপাশি তিনি সমাজকর্ম ও জমিদারি কাজে নিয়ােজিত ছিলেন। কবি হয়েও তিনি মানুষকে কর্মে অনুপ্রাণিত করেছেন। বাংলা সাহিত্যে তিনিই একমাত্র নােবেল বিজয়ী কবি।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম ও পরিবার

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৬১ সালের ৭ই মে (বাংলা ২৫শে বৈশাখ, ১২৬৮ বঙ্গাব্দ) কলকাতার জোড়াসাঁকোর এক সমৃদ্ধ ও সংস্কৃতিমনস্ক ঠাকুর পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম ছিল মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং মাতার নাম ছিল সারদা দেবী। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন তাদের চতুর্দশ সন্তান। পারিবারিক রীতিনীতি অনুযায়ী তিনি চার-পাঁচ বছর বয়সে গৃহশিক্ষকের কাছ থেকে পড়াশোনা শুরু করেন। ছোটবেলা থেকেই তিনি বাংলা, ইংরেজি, সংস্কৃত, বিজ্ঞান ও অস্থিবিদ্যা বিষয়ে শিক্ষা লাভ করেন। ছয় বছর বয়সে তিনি ওরিয়েন্টাল সেমিনারি নামক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি হন।

পারিবারিক প্রেক্ষাপট

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পারিবারিক বাসভবন ছিল জোড়াসাঁকোর ৬ নং দ্বারকানাথ ঠাকুর লেনে। সেখনেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম হয়েছিল। সেই যুগে জোড়াসাঁকো ছিল বাঙালি অধ্যুষিত অঞ্ছল। জোড়াসাঁকোর আশেপাশের অঞ্চলগুলো ছিল দারিদ্র্যপীড়িত। রবিন্দ্রনাথের পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন রাজা রামমোহন রায়ের (Ram Mohan Roy) বন্ধু এবং ব্রাহ্মধর্মের প্রধান সংগঠক। এরপর রামমোহন রায়ের মৃত্যুর পর দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্রাহ্মধর্মের প্রধান কেন্দ্রীয় ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠেন এবং তাকে মহর্ষি উপাধিতিতে ভূষিত করেন। অস্পৃশ্যতা প্রথার কারণে কেবল মাত্র পূর্ববঙ্গের (বর্তমান বাংলাদেশ Bangladesh) যশোর-খুলনার পিরালী ব্রাহ্মণ কন্যারাই ঠাকুর পরিবারে বধূ হয়ে আসতেন ।

শৈশব ও কৈশোরে রবীন্দ্রনাথ

রবীন্দ্রনাথ ছিলেন তার পিতামাতার চোদ্দো সন্তানের মধ্যে কণিষ্ঠতম। খুব ছোটবেলা থেকেই রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য ও সংস্কৃতির উপর আগ্রহ ছিল। তার কারন হল সে সময়ে জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবার সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চার জন্য নামডাক ছিল। দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর (রবীন্দ্রনাথ বড়দাদা) ছিলেন সম্মানীয় দার্শনিক ও কবি। সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর (রবীন্দ্রনাথের মেজদাদা) ছিলেন বাঙালি লেখক এবং ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসের প্রথম ভারতীয় সদস্য। স্বর্ণকুমারী দেবী (রবীন্দ্রনাথের দিদি) ছিলেন স্বনামধন্য ঔপন্যাসিক। মোট কথা রবীন্দ্রনাথের পরিবারটি ছিল শিক্ষা এবং সংস্কৃতির দিক দিয়ে খুবই উচ্চ। এবং এরই প্রভাব পরে রবীন্দ্রনাথের উপর। তবে রবীন্দ্রনাথের রচনার বড় অনুপ্রেরণা ছিল কাদম্বরী দেবী। কাদম্বরী দেবী ছিল জ্যোতিরিন্দ্রনাথের স্ত্রী। কাদম্বরী দেবী ও রবীন্দ্রনাথ দুজনেই খুবই ভাল বন্ধু ছিলেন। কিন্তু ১৮৮৪ সালে কাদম্বরী দেবী আত্মহত্যা করেন

শৈশবে রবীন্দ্রনাথ পিতার সান্নিধ্য তেমন পাননি কারন তার পিতা উত্তর ভারত, ইংল্যান্ড ও অন্যান্য পর্যটনে ব্যস্ত থাকতেন। মাত্র চোদ্দ বছর বয়সে ১৮৭৫ সালে রবীন্দ্রনাথ তার মাকে হারান। ধনাঢ্য পরিবার হাওয়া সত্ত্বেও রবীন্দ্রনাথকে থাকতে হয়েছে ভৃত্যদের তত্ত্বাবধানে।  ভৃত্যদের সন্তুষ্ট রাখতে বালক রবীন্দ্রনাথ অল্প আহার করতেন। রবীন্দ্রনাথকে পারিবারিক গণ্ডির মধ্যেই আবদ্ধ থাকতে হত। শুধু স্কুল ছাড়া ঘরের বাহিরে যাওয়া ছিল বারন।

রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাজীবন

পারিবারিক রীতি অনুযায়ী চার – পাঁচ বছর বয়সে গৃহশিক্ষকের কাছেই তার পড়াশুনা শুরু হয়। ছয় বছর বয়সে ওরিয়েন্টাল সেমিনারিতে (Oriental Seminary) ভর্তি হন। বছরখানেক পর নর্ম্যাল স্কুল, এরপর বেঙ্গল অ্যাকাডেমি এবং সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজিয়েট স্কুলে (St. Xavier’s Collegiate School) কিছুদিন করে পড়াশোনা করেছিলেন। কিন্তু বিদ্যালয়-শিক্ষায় অনাগ্রহী হওয়ায় বাড়িতেই গৃহশিক্ষক রেখে তার শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছিল।

১৮৭৩ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১১ বছর বয়সে তার উপনয়ন অনুষ্ঠিত হয়। এর পর তিনি পিতার সঙ্গে কয়েক মাসের জন্য দেশভ্রমণে বের হন। প্রথমেই তারা যান শান্তিনিকেতনের পারিবারিক এস্টেটে। সেখানকার প্রকৃতির ছোঁয়া তাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। এই সময়কার অভিজ্ঞতা নিয়ে রবীন্দ্রনাথ পরে লিখেছিলেন— “যাহা দেখিলাম না তাহার খেদ মিটিতে বিলম্ব হইল না – যাহা দেখিলাম তাহাই আমার পক্ষে যথেষ্ট হইল। এখানে চাকরদের শাসন ছিল না। প্রান্তরলক্ষ্মী দিক্‌চক্রবালে একটি মাত্র নীল রেখার গণ্ডী আঁকিয়া রাখিয়াছিলেন, তাহাতে আমার অবাধ সঞ্চরণের কোনো ব্যাঘাত করিত না।

পিতার কাছ থেকে সংস্কৃত ব্যাকরণ, ইংরেজি, জ্যোতির্বিজ্ঞান, সাধারণ বিজ্ঞান ও ইতিহাসের নিয়মিত পাঠ নিতে শুরু করেন। পরে ১৮৭৮ সালে অক্টোবর মাসে ব্যারিস্টারি পড়ার উদ্দেশে লন্ডনে যান। লন্ডনে তিনি  ব্রাইটন ও হোভের মেদিনা ভিলায় ঠাকুর পরিবারের একটি বাড়িতে অবস্থান করেন এবং স্কুলে পড়াশোনা শুরু করেন। পরবর্তীতে ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনে (University College London) ভর্তি হন। কিন্তু ১৮৮০ সালে কোন ডিগ্রি না নিয়ে রবীন্দ্রনাথ দেশে ফিরে আসেন। ইতোমধ্যে তার সাহিত্য প্রতিভার উম্মেষ ঘটে এবং বিভিন্ন পত্রিকায় তার লেখা প্রকাশিত হয়।


কর্মজীবনে রবীন্দ্রনাথ

লন্ডন থেকে ফিরে এসে ১৮৮৩ সালের ৯ ডিসেম্বর (২৪ অগ্রহায়ণ, ১২৯০ বঙ্গাব্দ) ঠাকুরবাড়ির অধস্তন কর্মচারী বেণীমাধব রায়চৌধুরীর কন্যা ভবতারিণীর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের বিবাহ সম্পন্ন হয়। বিয়ের পর ভবতারিণীর নাম পরিবর্তন করে মৃণালিনী দেবী। মাধুরীলতা, রথীন্দ্রনাথ, রেণুকা, মীরা, শমীন্দ্রনাথ এই পাঁচ সন্তানের পরিবার ছিল রবীন্দ্রনাথের।
১৮৯১ সালে পিতার আদেশক্রমে তিনি নদিয়া (নদিয়ার উক্ত অংশটি অধুনা বাংলাদেশের কুষ্টিয়া জেলা), রাজশাহী, পাবনা ও উড়িষ্যার ঠাকুর পরিবারের জমিদারি তদারকির করার জন্য বাংলাদেশে আসেন। সেখানে কুষ্টিয়ার শিলাইদহের কুঠিবাড়িতে তিনি দীর্ঘ সময় অতিবাহিত করেছিলেন। পদ্মা নামে বিলাসবহুল পারিবারিক বজরায় চড়ে প্রজাবর্গের কাছে খাজনা আদায় ও আশীর্বাদ প্রার্থনা করতে যেতেন। প্রজাবর্গের সাথে তিনি বন্ধুর মত মিশেছিলেন। তাই গ্রামবাসীরাও তার সম্মানে ভোজসভার আয়োজন করতেন।

সাহিত্য সাধনায় রবীন্দ্রনাথ

জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারে সর্বদা সাহিত্যের অনুকূল হাওয়া বইত। রবীন্দ্রনাথের জ্যৈষ্ঠ ভ্রাতা
দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সম্পাদনায় ১৮৭৭ সালে মাসিক ভারতী প্রকাশিত হয়। দাদার অনুপ্রেরণায় চোদ্দ বছর বয়সে তিনি বনফুল নামে একটি কাব্য রচনা করেন। এরপর কবিকাহিনী, সন্ধ্যাসংগীত, প্রভাতসংগীত, ছবি ও গান, কড়ি ও কোমল প্রভৃতি কাব্য একের পর এক প্রকাশিত হয়।

১৮৮২ সালে কলকাতার ১০ নং সদর স্ট্রিটে অবস্থানকালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘নিঝরের স্বপ্নভঙ্গ’ কবিতাটি রচনা করেন, যা তাঁর সাহিত্যিক জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ইঙ্গিতবাহী সৃষ্টি হিসেবে বিবেচিত। কলকাতার বাইরে পল্লিপ্রকৃতি ও সাধারণ মানুষের সংস্পর্শে এসে তাঁর সাহিত্য আরও গভীরতা ও বৈচিত্র্য লাভ করে। এই সময়েই তিনি ‘মানসী’, ‘সোনার তরী’, ‘চিত্রা’সহ অনেক বিখ্যাত কাব্য রচনা করেন। তাঁর সাহিত্যচর্চা চলতে থাকে বিরামহীনভাবে। রবীন্দ্রনাথের ‘গল্পগুচ্ছ’ নামক গল্পসংকলনে গ্রামবাংলার সাধারণ মানুষের সুখ-দুঃখের জীবনের চিত্র জীবন্ত হয়ে উঠেছে। মৃত্যুর আগের দিন পর্যন্ত তিনি কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক, গান, প্রবন্ধ, চিঠিপত্র, অনুবাদ, ভাষা ও সাহিত্যচর্চা, নন্দনতত্ত্ব ও চিত্রকর্মসহ অসংখ্য রচনার মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যকে অসাধারণভাবে সমৃদ্ধ করে গেছেন।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অর্জন

১৯১১ সালের ৭ই মে রবীন্দ্রনাথের বয়স ৫০ বছর পূর্ণ হওয়া উপলক্ষ্যে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ কর্তৃক কবিকে দেশবাসীর পক্ষ থেকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। নিজের অনুবাদ করা এবং ইংরেজ কবি ডব্লিউ বি ইয়েটস-এর সূচনা লেখা গীতাঞ্জলি প্রকাশিত হলে ১৯১৩ সালে রবীন্দ্রনাথ নােবেল পুরস্কার লাভ করেন। এ বছরই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাকে সম্মানসূচক ডক্টর অব ল’ উপাধিতে ভূষিত করেন। তাছাড়া রবীন্দ্রনাথের সম্মানার্থে বেশকিছু নামাঙ্কিত স্মারক রয়েছে। যেমন
ক) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নামাঙ্কিত বিশ্ববিদ্যালয় রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতা
খ) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, বীরভূম
গ) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জমিদারি কুঠিবাড়ি শিলাইদহ কুঠিবাড়ি, কুষ্টিয়া, বাংলাদেশ
ঘ) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সম্মানে বাংলাদেশে তার নামাঙ্কিত বিশ্ববিদ্যালয় রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়, শাহজাদপুর, সিরাজগঞ্জ
ঙ) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নামাঙ্কিত পশ্চিমবঙ্গের সর্বোচ্চ সাহিত্য পুরস্কার রবীন্দ্র পুরস্কার
চ) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নামাঙ্কিত ভারতের একটি জাতীয় হ্রদ রবীন্দ্র সরোবর, কলকাতা
ছ) রবীন্দ্রনাথ সড়ক, যশোর, বাংলাদেশ


বাঙালি জীবনে রবীন্দ্রনাথের প্রভাব

বর্তমান সংস্কৃতিতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রভাব অত্যন্ত ব্যাপক। নোবেল বিজয়ী দার্শনিক অমর্ত্য সেন (Amartya Sen) রবীন্দ্রনাথ একজন “হিমালয়প্রতিম ব্যক্তিত্ব” ও “গভীরভাবে প্রাসঙ্গিক ও বহুমাত্রিক সমসাময়িক দার্শনিক” রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে ভারতের সর্বকালের শ্রেষ্ঠ কবি হিসেবে বর্ণনা করা হয়ে থাকে। আজ বাঙালি সমাজ ২৫ শে বৈশাখ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মবার্ষিকী এবং ২২ শে শ্রাবণ প্রয়াণবার্ষিকী গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে পালন করে। তাছাড়া ঋতু উৎসব পালনের মাধ্যমেও কবিগুরুকে স্মরণ করা হয়। বিভিন্ন উৎসবে ও অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রসংগীত গাওয়া বা রবীন্দ্ররচনা পাঠের রেওয়াজও দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে।

শেষ জীবনে রবীন্দ্রনাথ

জীবনের মাঝ পথে এসে কবিগুরু অনেক কষ্ট সহ্য করেছেন। কারন ১৯০২ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর মাত্র ত্রিশ বছর বয়সে কবিপত্নী মৃণালিনী দেবী মারা যান।  এরপর ১৯০৩ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর কন্যা রেণুকা, ১৯০৫ সালের ১৯ জানুয়ারি পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর[ এবং ১৯০৭ সালের ২৩ নভেম্বর কনিষ্ঠ পুত্র শমীন্দ্রনাথের মৃত্যু হয়। এত বিয়োগ ব্যাথা সহ্য করার পরও সাহিত্য পিপাসু কবিগুরুর লিখা থেমে থাকে নি। জীবনের শেষ দশকে (১৯৩২-১৯৪১) রবীন্দ্রনাথের মোট পঞ্চাশটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। ধর্মীয় গোঁড়ামি ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠেছিলেন। জীবনের শেষ দিকে বিজ্ঞানের উপর আসক্তি বেরে যায় এবং ১৯৩৭ সালে প্রকাশিত হয় তার বিজ্ঞান-বিষয়ক প্রবন্ধ সংকলন বিশ্বপরিচয়।

শেষ চার বছর রবীন্দ্রনাথ ধারাবাহিকভাবে অসুস্থ ছিলেন। দুইবার তার তিনি শয্যাশায়ী ছিলেন। ১৯৩৭ সালে একবার অজ্ঞান হয়ে গেলে কবিগুরু অবস্থা আশঙ্কাজনক হয়ে পরেছিল। এরপর সেরে উঠেছিলেন। ১৯৪০ সালে আবার অসুস্থ হয়ে পরলে সে বার আর সেরে উঠতে পারেন নি। দীর্ঘ দিন অসুস্থ থাকার কারন, ১৯৪১ সালে ৮০ বছর বয়সে, জোড়াসাঁকোর নিজ বাসভবনে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুর সাত দিন আগে পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথ সৃষ্টিশীল ছিলেন

উপসংহার

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রতিভা বিচিত্র ও বহুমুখী হলেও তার প্রধান পরিচয় তিনি কবি। সত্য, সুন্দর, কল্যাণই তার আদর্শ। তিনি মানবতার কবি, প্রকৃতির কবি। পৃথিবীর রূপ-মাধুর্যকে তিনি আকণ্ঠ পান করেছেন। সীমার মাঝে অসীমের সন্ধান করেছেন। অপরূপ আলােয় আলােকিত এক জীবনের দিকেই ধাবিত তার সমগ্র সৃষ্টিকর্ম। তার অজস্র সৃষ্টি আমাদের শিল্প-সাহিত্যের অপরিমেয় সম্পদ হয়ে আছে। তিনি আমাদের মাঝে অমর হয়ে থাকবেন চিরকাল। বেঁচে থাকবেন নিজের সৃষ্টিকর্মের মাঝে।

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচনা ২

ভূমিকা

এই আশ্চর্য বিশ্বে কালের গর্ভ থেকে কখনো কখনো এমন কিছু অত্যাশ্চর্য অভাবনীয় এবং বিরল প্রতিভার জন্ম হয় যারা তাদের কর্মে ব্যক্তিত্বে ও মহত্বে সময়কেও ছাপিয়ে গিয়ে বিশ্বে চির অমর হয়ে থাকেন। মানবজাতির কাছে মহাকালের এমনই এক শ্রেষ্ঠ দান কবিগুরু তথা মহামানব শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। বিশ্বে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এমনই এক দানবীয় প্রতিভা যিনি সর্বযুগে সর্বকালে চির প্রাসঙ্গিক চির নবীন ও চিরন্তন রূপে শাশ্বত।সাধারণ মানুষের চিন্তার ক্ষুদ্র পরিসরে রবীন্দ্রনাথকে আলোচনা করতে গেলে তা হবে সমগ্র মহাসিন্ধুর এক ক্ষুদ্র বিন্দুর ন্যায়। তবুও আমাদের সীমিত ক্ষমতার মধ্যে দিয়েই আমরা এই মহামানবকে আত্মস্থ করার চেষ্টা করি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এমনই এক বিরল প্রতিভা যার মধ্যে বিশ্বের প্রায় সকল প্রকার সাংস্কৃতিক তথা সামাজিক গুণাবলী বর্তমান ছিল।জীবদ্দশায় তার অতিমানবিক মেধায় এবং অকৃত্রিম মহামানবিক দানে তিনি পূর্ণ করে দিয়ে গিয়েছেন এই পৃথিবীর সাংস্কৃতিক তথা সামাজিক চিন্তা জগতকে। নিজের অনন্য শাশ্বত চিন্তাধারায় তিনি ছাপিয়ে গিয়েছেন জাতি দেশ কালের সকল গন্ডি এমনকি বারে বারে অতিক্রম করে গিয়েছেন নিজের ঐকান্তিক পরিচয়কেও। তাই মহর্ষির ন্যায় প্রজ্ঞা দৃষ্টিসম্পন্ন এই মহামুনির জীবনের মহাযজ্ঞকে কোন একটি নির্দিষ্ট সংজ্ঞায় সংজ্ঞায়িত করা সম্পূর্ণরূপে অসম্ভব।

বংশ পরিচয়

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবন সম্পর্কে আলোকপাত করার পূর্বে আমাদের তার বংশ পরিচয় সম্পর্কে জেনে নেওয়া একান্ত জরুরী। মনে রাখা দরকার কোন মহান প্রতিভা বা ব্যক্তিত্বের শিকড় প্রোথিত থাকে তার বংশের ইতিহাসের মধ্যেই। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন তৎকালীন কলিকাতা শহরের অন্যতম অভিজাত ঠাকুর পরিবারের সন্তান। এই ঠাকুরদের আদি পদবী কুশারী আদি বাসস্থান কুশ নামক গ্রাম বা বর্তমান বর্ধমান জেলা।এই বংশেরই এক সন্তান জগন্নাথ কুশারীর হাত ধরে কুশারীরা বাংলার বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে। এদেরই এক শাখা ইংরেজ বণিকদের হয়ে ভারতীয় ব্যবসা বাণিজ্যে মধ্যস্থতাকারীর কাজ করতো। কাজের সূত্রে বন্দর সংলগ্ন জেলেপাড়ায় কুশারীদের নিয়মিত যাতায়াত ছিল।কথিত আছে জেলেরা তাদের সুন্দর চেহারার জন্যে ঠাকুর বলে ডাকা শুরু করলে কালক্রমে কুশারীরা ঠাকুর পদবীতেই পরিচিতি লাভ করে। পরবর্তীতে পারিবারিক অন্তর্দ্বন্দ্বকে কেন্দ্র করে ঠাকুর পরিবার পাথুরিয়াঘাটা এবং জোড়াসাঁকো এই দুইটি শাখায় ভাগ হয়ে যায়। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই বংশের জোড়াসাঁকো শাখার সন্তান।


জন্ম ও তারিখ

১৮৬১ খ্রিস্টাব্দের ৭ই মে জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম হয়। তাঁর পিতা ছিলেন মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং মা শ্রীমতি সারদা দেবী। তিনি ছিলেন তার পিতামাতার চতুর্দশতম সন্তান। রবীন্দ্রনাথের পিতামহ প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর তৎকালীন সময়ে সমাজের শীর্ষ স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিদের মধ্যে একজন ছিলেন। প্রিন্স দ্বারকানাথ ছিলেন ভারতবর্ষের প্রথম বাঙালি ব্যবসায়ী যিনি আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে লিপ্ত হয়েছিলেন।তাদের পরিবারের ছিল নুনের ব্যবসা। যদিও চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তনের পর ঠাকুর পরিবার বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে বেশকিছু জমিদারি কিনে নেয়। তবে রবীন্দ্রনাথের পিতৃদেব মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর বিষয় আশয়ের তুলনায় আধ্যাত্মিকতা সংস্কৃতি চর্চা এবং জনহিতৈষী কাজকর্মে অধিক মনোযোগী ও আগ্রহী ছিলেন। রবীন্দ্রনাথের পিতৃদেবের সময় থেকেই জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবার বাংলার আধুনিক সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চার পীঠস্থান হয়ে ওঠে।

শৈশব ও বাল্যকাল


কবিগুরুর বাল্যকাল তেমনি ঘটনাবহুল ছিলনা। নানা পারিবারিক অনুশাসন এবং নিয়মকানুনের মধ্যে কেটেছিল তার শৈশব। মাত্র ১৪ বছর বয়সে মাকে হারিয়ে অন্যান্য সাধারণ সন্তানদের মতই অভিজ্ঞ পরিচারকদের কাছে রবীন্দ্রনাথ লালিত পালিত হন। তথাকথিত পারিবারিক স্নেহ এবং আদর থেকে তার ছেলেবেলা ছিল বঞ্চিত। যদিও নিজের আত্মজীবনী জীবনস্মৃতিতে কবিগুরু উল্লেখ করেছেন এই তার কাছে অনাদর ছিল এক মস্ত স্বাধীনতা। এই আত্মজীবনীতেই তিনি তার ছেলেবেলা সম্পর্কে নানা বৈচিত্র্যময় অভিজ্ঞতার কাহিনী লিপিবদ্ধ করে গিয়েছেন।

শিক্ষাজীবন

রবীন্দ্রনাথ ছিলেন একজন অস্বাভাবিক প্রতিভাবান শিশু। তাই তার শিক্ষাজীবনও ছিল অন্য সবার থেকে আলাদা। ছোটবেলায় তিনি এক বড় ভাই ও কয়েকজন গৃহশিক্ষকের কাছে পড়াশোনা শুরু করেন। এরপর তিনি ওরিয়েন্টাল সেমিনারি, নর্মাল স্কুল, বেঙ্গল একাডেমি ও সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুলে কিছুদিন পড়েন। তবে স্কুলের নিয়ম-কানুন ও পরিবেশ তার ভালো লাগেনি, তাই পরে বাড়িতেই গৃহশিক্ষকের সাহায্যে পড়াশোনার ব্যবস্থা করা হয়। কলকাতার ব্যস্ত জীবনের চেয়ে তিনি বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন পানিহাটি বা বোলপুরের প্রকৃতির কাছাকাছি থাকতে। এসব জায়গায় থাকাকালীন তিনি তার পিতার কাছ থেকে বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করেন। দেশ ভ্রমণের সময়ও তিনি সংস্কৃত ব্যাকরণ, জ্যোতির্বিজ্ঞান, সাধারণ বিজ্ঞান ও ইতিহাসের মতো বিষয়ে অভিজ্ঞতা লাভ করেন। ১৮৭৮ সালে ব্যারিস্টারি পড়ার উদ্দেশ্যে রবীন্দ্রনাথকে ইংল্যান্ডে পাঠানো হয়। তিনি ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনে আইন নিয়ে পড়াশোনা শুরু করলেও দেড় বছরের মধ্যেই পড়া শেষ না করেই ডিগ্রি ছাড়া দেশে ফিরে আসেন।

বিবাহ ও ব্যক্তিগত জীবন

১৮৭৩ সালে পিতার সাথে দেশভ্রমণে বেরোনোর পূর্বে জোড়াসাঁকোর বাড়িতে রবীন্দ্রনাথের উপনয়ন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ছেলেবেলায় নতুন দাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথের স্ত্রী কাদম্বরী দেবীর সাথে কবিগুরুর গভীর সখ্যতা গড়ে ওঠে। তিনি ছিলেন রবীন্দ্রনাথের নতুন বৌঠান। তারপর ২২ বছর বয়সে ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দে ঠাকুরবাড়িরই এক অধঃস্তন কর্মচারী বেনীমাধব রায়চৌধুরীর একাদশ বর্ষীয়া কন্যা ভবতারিণীর সাথে কবিগুরুর বিবাহ সম্পন্ন হয়।বিবাহের পর তার স্ত্রী এর নাম হয় মৃণালিনী দেবী। এই দম্পতির মোট পাঁচজন সন্তান হয়েছিল। তারা হলেন যথাক্রমে মাধুরীলতা রথীন্দ্রনাথ রেনুকা মীরা এবং শমীন্দ্রনাথ। এদের মধ্যে রেনুকা এবং শমীন্দ্রনাথের খুব অল্প বয়সেই মৃত্যু হয়।

কর্মজীবন

প্রকৃতপক্ষে রবীন্দ্রনাথের কর্মজীবন এতটাই বিস্তৃত যে তা নিয়েই এই ক্ষুদ্র পরিসরে আলোচনা সম্ভব নয়। তবে পারিবারিক সূত্রে তিনি পেশাগতভাবে জমিদারি সামলানো খাজনা আদায় এবং মহাল পরিদর্শনের মত বৈষয়িক কাজে বাংলার বিভিন্ন জায়গায় পরিভ্রমণ করেন। তাই চিন্তাবিদ রবীন্দ্রনাথের থেকে এক্ষেত্রে আমরা বৈষয়িক রবীন্দ্রনাথকে আলাদা করে আলোচনার চেষ্টা করব।বিলেত থেকে দেশে ফিরে আসবার পর ১৮৯১ সাল থেকে পিতার আদেশে নদিয়া জেলা রাজশাহী পাবনা তথা উড়িষ্যার বিভিন্ন অঞ্চলে পারিবারিক জমিদারিগুলি তদারকির কাজে রবীন্দ্রনাথ নিয়োজিত হন। নিজের পারিবারিক বজরায় চড়ে তিনি এই জমিদারিগুলির তদারকিতে যেতেন। প্রজাদের মধ্যেও ব্যাপক জনপ্রিয় কবিগুরুর সম্মানে গ্রামবাসীরা জমিদারের উপস্থিতিতে ভোজসভার আয়োজন করত।

কবি রবীন্দ্রনাথ

সবকিছুর ঊর্ধ্বে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন একজন কবি। তিনি তাঁর কাব্য সৃষ্টির দ্বারা বিভোর করে দিয়েছেন সমগ্র বিশ্বকে। মাত্র আট বছর বয়সে কবিগুরু কাব্য রচনা শুরু করেন। তার প্রকাশিত মৌলিক কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা ৫২। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর প্রথম জীবনে ছিলেন কবি বিহারীলাল চক্রবর্তী দ্বারা অনুপ্রাণিত। অনুপ্রেরণার এই চাপ তার প্রথম দিককার কবিতাগুলিতে পাওয়া যায়। অন্যদিকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত বেশকিছু কবিতায় লালন ফকিরের বাউল গান রামপ্রসাদী গান উপনিষদের দর্শন তথা বৈষ্ণব পদাবলীর বিভিন্ন প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। যদিও পরবর্তীতে কবিগুরু সম্পূর্ণ নিজস্ব ঘরানায় অজস্র কাব্য রচনা করেন। এসকল কাব্যে তার জীবনের বিভিন্ন গভীর দর্শন যেমন প্রেম সৌন্দর্য আধ্যাত্মিকতা বাস্তব জীবনের বিভিন্ন সমস্যা আনন্দ বিষন্নতা ইত্যাদি ফুটে ওঠে।কবিগুরু রচিত যে বইটি বিশ্বের সর্বাপেক্ষা বিখ্যাত সেটি হল গীতাঞ্জলি। তাছাড়া সঞ্চিতা গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সকল কবিতা একত্রে সংকলিত রয়েছে। মৃত্যুর মাত্র আট দিন পূর্বে বিংশ শতাব্দীর এই মহামানব মৌখিকভাবে তার শেষ কবিতা তোমার সৃষ্টির পথ রচনা করেন।

সঙ্গীতস্রষ্টা রবীন্দ্রনাথ

বিশ্বকবি যে ভূমির সন্তান সেই বাংলার মানুষের কাছে তার পরিচয় কবির থেকেও বেশি একজন সঙ্গীতস্রষ্টা রূপে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার জীবনে মোট ১৯১৫টি গান রচনা করেছিলেন। প্রথমদিকে তার সংগীত রচনায় ভ্রাতা জ্যোতিরিন্দ্রনাথের অনুপ্রেরণা লক্ষ্য করা যায়। বিশ্বকবি ভারতীয় ধ্রুপদী সংগীত পল্লী সংগীত এবং ইউরোপীয় সুরশৈলীর মিশ্রণে একটি নিজস্ব স্বকীয় সুরশৈলী নির্মাণ করেন।তার প্রথম দিককার সঙ্গীত রচনায় বিভিন্ন প্রভাব লক্ষ্য করা গেলেও পরবর্তীতে নিজের বিভিন্ন কবিতাকে স্বকীয় নিজস্ব সুরের মূর্ছনায় তিনি গানে রূপান্তরিত করেন। তার গান গুলির মধ্যে সমসাময়িক বিভিন্ন ঘটনার প্রভাব স্পষ্ট। এই সমস্ত ঘটনাবলিকে কেন্দ্র করে কবিগুরুর ব্যক্তিগত দর্শন গান গুলির মধ্যে দিয়ে প্রতিফলিত হয়। গানের সাথে সাথে নৃত্যকলাকেও রবীন্দ্রনাথ সমান গুরুত্বের সাথে দেখতেন। তিনি ইউরোপীয় অপেরার আদলে বাংলা নৃত্যনাট্যের সূচনা ঘটান।

সাহিত্যিক রবীন্দ্রনাথ

গান ও কবিতার পাশাপাশি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচনা করেছেন অনেক অমর উপন্যাস, ছোটগল্প, নাটক ও প্রবন্ধ। তিনি বাংলা সাহিত্যের প্রথম সফল ছোটগল্পকার হিসেবে পরিচিত। তার লেখা ছোটগল্পগুলো সমসাময়িক বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় নিজের নাম বা ছদ্মনামে প্রকাশিত হতো। ‘ক্ষুধিত পাষাণ’, ‘মনিহারা’, ‘নষ্টনীড়’, ‘কাবুলিওয়ালা’—এইসব গল্পগুলো বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। উপন্যাসিক হিসেবেও রবীন্দ্রনাথ অনন্য; তিনি জীবনে মোট ১৩টি উপন্যাস রচনা করেন, যেগুলোও বিভিন্ন পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছিল। তাঁর রচিত নাটকগুলোও বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। এছাড়াও, সমকালীন নানা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোকপাত করার উদ্দেশ্যে তিনি বিভিন্ন প্রবন্ধ লেখেন। কবিগুরুর প্রতিটি রচনায় আমরা তার গভীর চিন্তা ও দর্শনের পরিচয় পাই।

চিত্রশিল্পী রবীন্দ্রনাথ

চিত্রশিল্পে রবীন্দ্রনাথের কোন প্রথাগত শিক্ষা না থাকলেও তিনি তার চিত্রকলায় বহু ধরনের অংকনশৈলী রপ্ত করেছিলেন। নিয়মিতভাবে তার ছবি আঁকা শুরু প্রায় ৭০ বছর বয়সে।  খুব অল্প সময়ের মধ্যে প্রায় আড়াই হাজার ছবি তিনি একেছিলেন। এর মধ্যে অধিকাংশই শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রভবনের আর্ট গ্যালারিতে সংরক্ষিত আছে।

শিক্ষাবিদ রবীন্দ্রনাথ

কবিগুরু নিজে যেমন প্রথাগত পুঁথিগত বদ্ধ শিক্ষা ব্যবস্থা অপছন্দ করতেন তেমনি শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নতির জন্য তার অবদান অবিস্মরনীয়। জীবদ্দশায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশ তার ভ্রমণের সুযোগ হয়েছিল। এই সকল দেশের ব্যাপক উন্নতির উদাহরণ এবং সনাতন ভারতীয় ঐতিহ্যের একত্র মিশেলে তিনি এক বিশেষ ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থার প্রচলন করেন।বোলপুরের শান্তিনিকেতনে কবিগুরুর উদ্যোগে এই শিক্ষার প্রচার ও প্রসারের উদ্দেশ্যে স্থাপিত হয় বিশ্বভারতী আশ্রমিক বিশ্ববিদ্যালয়। এই আশ্রমে সনাতনী ভারতীয় ঐতিহ্য অনুসারে কবিগুরু ব্রহ্মচর্য ও গুরুপ্রথার পুনঃপ্রবর্তন করেছিলেন। এখানকার শিক্ষার্থীদের পাঠ্যক্রমে তিনি অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন এমন সব বিষয় যা তাদের বৌদ্ধিক বিকাশ ঘটিয়ে বিশ্বচেতনার সাথে ভারতীয় মনকে একসূত্রে একীভূত করবে।

রাজনৈতিক মতাদর্শ ও চিন্তাধারা

রবীন্দ্রনাথের রাজনৈতিক দর্শন ছিল তুলনামূলক ভাবে জটিল। একদিকে যেমন তিনি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা এবং ভারতীয় জাতীয়তাবাদের সমর্থন করতেন অন্যদিকে তিনি বিরোধিতা করতেন নৈরাজ্যমূলক বিপ্লবের। এই প্রসঙ্গে বলা যায় ১৯১৯ সালে জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে তিনি যেমন নাইট উপাধি প্রত্যাখ্যান করেন আবার ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে স্বদেশী আন্দোলনকে চরকা সংস্কৃতি বলে বিদ্রূপ করেন।প্রকৃতপক্ষে তার মতাদর্শ ছিল জনসাধারণের আত্মিক এবং বৌদ্ধিক উন্নতির মাধ্যমে সর্বাত্বক মুক্তিলাভ। তবে রবীন্দ্রনাথ তৎকালীন ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের বিভিন্ন সমাবেশে সশরীরে যোগদান করেন। বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে করেন জাতি ধর্ম নির্বিশেষে রাখি বন্ধন উৎসব। তার রচিত বিভিন্ন গান ও কবিতা তৎকালীন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের বিশেষভাবে উদ্বুদ্ধ করেছিল।

সম্মান

জীবদ্দশায় তার নানা কীর্তির জন্য তিনি অসংখ্য পুরস্কার এবং সম্মানে ভূষিত হন। এগুলির মধ্যে ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজি ভাষায় অনুবাদিত গীতাঞ্জলি বই এর জন্য প্রাপ্ত নোবেল পুরস্কারটি সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য। তাছাড়া সমকালীন ইংরেজ সরকার তাকে নাইটহুড সম্মানও ভূষিত করে।

উপসংহার

ভারতের এই অসাধারণ প্রতিভাধর ব্যক্তিত্ব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯৪১ সালের ৭ই আগস্ট মহাপরিনির্বাণ লাভ করেন। তার অনন্য ও চিরন্তন সাহিত্যকর্মের মাধ্যমে তিনি আজও বিশ্ববাসীর হৃদয়ে জীবন্ত হয়ে আছেন। তিনি বাঙালি জাতির সম্মান ও গৌরব বহুগুণে বাড়িয়ে বিশ্ব দরবারে তুলে ধরেছিলেন। তবে তিনি শুধু একজন বাঙালি নন, বরং সত্যিকারের একজন বিশ্বনাগরিক, যার হৃদয় ছিল বাল্মীকী ও কালিদাসের মতো গভীর আর সমাজচেতনা ছিল টলস্টয়ের মতো উদার। তাই রবীন্দ্রনাথ শুধুমাত্র একজন ব্যক্তি নন, তিনি হলেন সব দেশের, সব কালের, সব মানুষের জন্য এক পবিত্র প্রেরণাস্থল। এই রচনাটি পড়ে আপনার কেমন লাগলো তা কমেন্টে জানাতে ভুলবেন না। আমরা সব সময় চেষ্টা করি আপনাদের পছন্দমতো সুন্দর রচনা তুলে ধরতে। এখানে পছন্দের রচনা না পেলে, তার নাম কমেন্ট করে জানালে দ্রুত সেটিও যুক্ত করার চেষ্টা করবো। সম্পূর্ণ রচনাটি পড়ার জন্য আপনাকে আন্তরিক ধন্যবাদ।

উপসংহার: রচনাটি পড়ে ভালো লাগলে, StudyTika.com ওয়েবসাইটে আরও অনেক সহজ ও সুন্দর রচনা রয়েছে। একবার দেখে এসো।

Getting Info...

إرسال تعليق

Oops!
It seems there is something wrong with your internet connection. Please connect to the internet and start browsing again.