বাংলাদেশের প্রাকৃতিক দুর্যোগ নিয়ে একটি সহজ ও সুন্দর রচনা এই ব্লগপোস্টে দেওয়া হয়েছে। ক্লাস ৭, ৮, ৯, ১০, এসএসসি ও এইচএসসি শিক্ষার্থীদের জন্য খুবই উপযোগী। চলুন পুরো রচনাটি পড়ে নেই।
বাংলাদেশের প্রাকৃতিক দুর্যোগ রচনা ১
ভূমিকা
বাংলাদেশ একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ দেশ, কারণ এর ভৌগোলিক অবস্থান, জলবায়ু ও ভূতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য একে প্রায় প্রতি বছরই নানা ধরনের দুর্যোগের মুখোমুখি করে তোলে। ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, খরা, ভূমিকম্প ও নদীভাঙনের মতো দুর্যোগে দেশের মানুষ ও সম্পদের বড় ধরনের ক্ষতি হয়। এসব দুর্যোগ দেশের অর্থনীতি, জনস্বাস্থ্য ও অবকাঠামোর ওপর তীব্র প্রভাব ফেলে। তাই দুর্যোগ মোকাবিলায় পূর্বপ্রস্তুতি নেওয়া খুবই জরুরি। সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি সংস্থা ও সাধারণ মানুষের মিলিত প্রচেষ্টায় সময়মতো পদক্ষেপ গ্রহণ করলে দুর্যোগজনিত ক্ষয়ক্ষতি অনেকটাই কমানো সম্ভব।
প্রাকৃতিক দুর্যোগ বলতে কী বোঝায়?
প্রাকৃতিক দুর্যোগ বলতে বোঝায় প্রকৃতি ও তার উপাদানের অস্বাভাবিক পরিবর্তন, যা পরিবেশ, জনজীবন এবং অর্থনীতিতে বিপর্যয় সৃষ্টি করে। সাধারণত মানুষের নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকা এসব দুর্যোগ হঠাৎ করেই ঘটে থাকে এবং তাৎক্ষণিকভাবে ব্যাপক ক্ষতির কারণ হয়। বাংলাদেশে যে প্রাকৃতিক দুর্যোগগুলো বেশি দেখা যায় তার মধ্যে বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, ভূমিকম্প, খরা, নদীভাঙন এবং কালবৈশাখী অন্যতম।
বাংলাদেশের প্রধান প্রাকৃতিক দুর্যোগগুলো
১. বন্যা
বাংলাদেশের অন্যতম বড় প্রাকৃতিক দুর্যোগ হলো বন্যা। এ দেশের ভৌগোলিক অবস্থান, ভূতাত্ত্বিক কাঠামো, অতিবৃষ্টি, একই সময়ে প্রধান নদীসমূহের পানি বৃদ্ধি, নদীতে পলি জমা ইত্যাদি কারণে প্রায় প্রতিবছরই এই দেশ বন্যার শিকার হয়। বন্যা প্রতি বছর হাজার হাজার মানুষকে গৃহহীন করে এবং ফসলের মারাত্মক ক্ষতি করে। অতীতে ১৯৫৪, ১৯৭৪, ১৯৮৮, ২০০৪ সালের বন্যায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। এর প্রভাব শুধু জীবন ও সম্পদ ধ্বংসেই সীমাবদ্ধ থাকে না; এটি দেশের অর্থনীতি ও খাদ্য নিরাপত্তাকেও মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত করে।
২. ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস
ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস বাংলাদেশে ভয়াবহ প্রভাব ফেলে। প্রতিবছর বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট নিম্নচাপ ও ঘূর্ণিঝড় উপকূলীয় এলাকায় আঘাত হানে, যার ফলে অনেক মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়ে এবং ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়। ১৯৭০ সালের প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ে বিপুল প্রাণহানি ঘটে, যা আজও মানুষের মনে ভয়াবহ স্মৃতি হিসেবে রয়ে গেছে। এরপর ২০০৭ সালের সিডর ও ২০০৯ সালের আইলা ঘূর্ণিঝড় দেশে বিশাল ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। একইভাবে ২০১৯ সালের বুলবুল ও ২০২০ সালের আম্পান ঘূর্ণিঝড়ও উপকূলীয় অঞ্চলে ব্যাপক ক্ষতি সাধন করে।
৩. খরা
বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ হওয়ায় খরার প্রভাব এখানে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। খরার কারণে ফসলের উৎপাদনে বিরূপ প্রভাব পড়ে এবং জলাধার শুকিয়ে যায়। খরার কারণে মাটির আর্দ্রতা কমে যায় এবং তা জমির উর্বরতাকে প্রভাবিত করে। ফলে কৃষিজীবী মানুষজনকে দুর্ভোগ পোহাতে হয় এবং দেশের খাদ্য নিরাপত্তা বিপন্ন হয়ে ওঠে। বিশেষ করে উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় জেলা সমূহ খরার সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকে।
৪. ভূমিকম্প
বাংলাদেশ ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চলের মধ্যে একটি এবং প্রতিনিয়তই এরকম ঝুঁকির মুখোমুখি হতে হয়। যদিও এখন পর্যন্ত বড় আকারের ভূমিকম্পে দেশটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি, তবে মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্পে চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন শহরে ক্ষয়ক্ষতি পরিলক্ষিত হয়েছে। ভূমিকম্পের সবচেয়ে বড় ঝুঁকি ঢাকায়, কারণ এখানে অবকাঠামো অনেকটাই দুর্বল। অপরিকল্পিত নগরায়ণ এবং ভূমিকম্প-প্রতিরোধী অবকাঠামোর অভাবে ঢাকা শহর ভূমিকম্পের সময় মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারে।
৫. নদীভাঙন
নদীভাঙন বাংলাদেশের নদীমাতৃক অঞ্চলে এক বড় সমস্যা। নদীভাঙনের ফলে প্রতি বছর অনেক মানুষ তাদের বসতবাড়ি এবং কৃষিজমি হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়ে। পদ্মা, মেঘনা, যমুনা প্রভৃতি নদীগুলোর পাড়ে বসবাসকারী মানুষেরা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকে। নদীভাঙনের কারণে এসব অঞ্চলের মানুষজনকে প্রায়শই স্থানান্তর করতে হয়।
৬. কালবৈশাখী
বাংলাদেশের আরেকটি নিয়মিত প্রাকৃতিক দুর্যোগ হলো কালবৈশাখী। চৈত্র-বৈশাখ মাসে সৃষ্ট এই ঝড় সাধারণত বজ্রপাত ও প্রবল বাতাসসহ আঘাত হানে। বিশেষ করে গ্রীষ্মকালে মাঠে থাকা ফসলের ওপর এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে এবং অনেক সময় ঘরবাড়ি ও অন্যান্য সম্পদের ক্ষতি হয়।
প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রতিরোধের উপায়
১. পূর্বপ্রস্তুতি এবং দুর্যোগ মোকাবিলা প্রশিক্ষণ
দুর্যোগের সময় ক্ষয়ক্ষতি কমাতে পূর্বপ্রস্তুতি নেওয়া অত্যন্ত জরুরি। যদি আগে থেকেই সঠিক পূর্বাভাস দেওয়া যায় এবং সাধারণ মানুষকে দুর্যোগকালীন করণীয় সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়, তাহলে তাদের সচেতনতা বাড়বে। এতে করে তারা দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পারবে এবং ক্ষতির মাত্রা অনেকটাই হ্রাস পাবে। যেমন, বন্যা বা ঘূর্ণিঝড়ের সময় নিরাপদ আশ্রয়কেন্দ্র ব্যবহার এবং খাবার ও পানির ব্যবস্থা আগেভাগে করে রাখাই পারে প্রাণ ও সম্পদ রক্ষায় বড় ভূমিকা রাখতে।
২. উন্নত অবকাঠামো নির্মাণ
দুর্যোগপ্রতিরোধে উন্নত অবকাঠামো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বন্যার প্রতিরোধে বাঁধ এবং নদী খনন, উপকূলীয় এলাকায় সাইক্লোন শেল্টার তৈরি এবং ভূমিকম্পপ্রতিরোধী স্থাপনাগুলোর সংখ্যা বাড়ানো উচিত। খরার সময় কৃষিজমিতে সেচব্যবস্থা নিশ্চিত করা এবং পানির সংরক্ষণ ব্যবস্থা চালু করা দরকার।
৩. দুর্যোগ সংক্রান্ত নীতিমালা ও পরিকল্পনা প্রণয়ন
সরকারি এবং বেসরকারি সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের মাধ্যমে দুর্যোগ সংক্রান্ত নীতিমালা এবং পরিকল্পনা প্রণয়ন করা প্রয়োজন। যেমন, দুর্যোগকালীন সময়ে দ্রুত যোগাযোগ ব্যবস্থা চালু রাখা এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের তৎপরতা বাড়ানো। দুর্যোগ মোকাবিলায় সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সমন্বয় ঘটানো একান্ত জরুরি।
৪. জনসচেতনতা বৃদ্ধি
দুর্যোগকালীন পরিস্থিতি মোকাবিলায় সর্বপ্রথম জনগণের সচেতনতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিভিন্ন প্রচার মাধ্যম, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগের মাধ্যমে জনসচেতনতা সৃষ্টি করা যেতে পারে। এজন্য দূরদর্শন, বেতার, পত্রপত্রিকা, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সাহায্যে সাধারণ মানুষের কাছে দুর্যোগকালীন প্রস্তুতির প্রয়োজনীয় তথ্য পৌঁছে দেওয়া দরকার।
৫. গাছপালা রক্ষা এবং বনায়ন কর্মসূচি
বন্যা ও খরার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রতিরোধে বৃক্ষরোপণ এবং বনায়ন কর্মসূচির ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গাছপালা ভূমিধস প্রতিরোধে সহায়ক এবং মাটির ক্ষয় রোধ করে। তাছাড়া বনায়ন পানি সংরক্ষণেও সহায়ক ভূমিকা পালন করে এবং স্থানীয় জলবায়ুর ভারসাম্য রক্ষা করে।
উপসংহার
বাংলাদেশের জন্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ একটি বড় চ্যালেঞ্জ। তবে সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে এসব দুর্যোগের ক্ষতি অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। প্রাকৃতিক দুর্যোগ আমাদের বাস্তবতা; তাই আমাদের সেই বাস্তবতার সাথে মানিয়ে চলতে হবে এবং কার্যকরী প্রস্তুতি ও প্রতিকার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ রোধে সাধারণ মানুষকে সচেতন ও প্রশিক্ষিত করার পাশাপাশি সরকার এবং বিভিন্ন সংস্থার সম্মিলিত উদ্যোগ অপরিহার্য। ভবিষ্যতে প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝুঁকি কমাতে টেকসই পরিকল্পনা ও পরিবেশ বান্ধব কার্যক্রম চালিয়ে যেতে হবে।
বাংলাদেশের প্রাকৃতিক দুর্যোগ রচনা ২
উপস্থাপনা
ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে আমাদের দেশ প্রাকৃতিক দুর্যোগে বেশি আক্রান্ত হয়। এ দেশটি নদীবাহিত পলিমাটিতে তৈরি একটি বদ্বীপ। বিশাল গঙ্গা-যমুনা-মেঘনার প্রবাহ মিলিয়ে সাতশত নদ-নদী বয়ে গেছে এদেশের ওপর দিয়ে।
তার ওপর এদেশের দক্ষিণাংশ জুড়ে রয়েছে বঙ্গোপসাগর; যার আকার অনেকটা ওল্টানো ফানেলের মতো। ফলে সাগরে ঝড় উঠলেই প্রবল দক্ষিণা হাওয়ার তোড়ে সমুদ্রের লোনা পানি উঁচু হয়ে গড়িয়ে পড়ে নিচু উপকূলে। আর এতেই সৃষ্ট হয় প্রাকৃতিক দুর্যোগ ।
প্রাকৃতিক দুর্যোগের ধরন
ভৌগোলিক দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া প্রাকৃতিক দুর্যোগগুলোকে মূলত তিনটি প্রধান শ্রেণিতে ভাগ করা যায়। প্রথমত, বায়ুমণ্ডলে সংঘটিত দুর্যোগ যেমন—কালবৈশাখী ঝড়, ঘূর্ণিঝড়, হারিকেন, টর্নেডো, খরা ও অতিবৃষ্টি। দ্বিতীয়ত, ভূপৃষ্ঠে সৃষ্ট দুর্যোগ যেমন—বন্যা, ভূমিধস, নদীভাঙন ও ভূ-অভ্যন্তরস্থ পানিদূষণ। তৃতীয়ত, ভূ-গর্ভস্থ দুর্যোগ যেমন—ভূমিকম্প ও অগ্ন্যুৎপাত। এই দুর্যোগগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় ঝড়-ঝঞ্ঝা, নদীভাঙন, খরা, ভূমিধস এবং ভূগর্ভস্থ পানিদূষণের কারণে।
কালবৈশাখি
বাংলাদেশে প্রায় প্রতিবছরই নানা দুর্যোগ সংঘটিত হয়ে থাকে। কালবৈশাখির ফলে বাংলার বহু এলাকা বিধ্বস্ত হয়। ঝড়ের তাণ্ডবলীলায় গাছপালা, ঘরবাড়ি ভেঙে যায়। মারা যায় হাজার হাজার গরু বাছুর, পাখপাখালি, মানুষ হয় অসহায়। কিছুদিন পূর্বে এমনি এক কালবৈশাখির শিকার হয়েছিল মানিকগঞ্জের সাটুরিয়ার জনসাধারণ।
১৯৮৯ সালে সুন্দরবন এলাকা, ১৯৯১ সালে গাজীপুর এবং ১৯৯৬ সালে টাঙ্গাইলের অনেক থানা বিধ্বস্ত হয়েছে প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ে। নিশ্চিহ্ন হয়েছে বহু গ্রামগঞ্জ । প্রায় প্রতিবছরই বাংলাদেশের কোনো না কোনো অঞ্চলের ওপর দিয়ে এরকম কালবৈশাখি বয়ে যায়।
ঘূর্ণিঝড়
ঘূর্ণিঝড়ে বাতাসের তীব্রতা হয় অনেক বেশি। কখনো কখনো তা ঘণ্টায় ২৫০ কিলোমিটার বেগে বয়ে যায়। সমুদ্রে সৃষ্টি হয় জলোচ্ছ্বাসের ৷ প্রতিবছরই এপ্রিল-মে এবং অক্টোবর-নভেম্বরে বাংলাদেশে ছোটো-বড়ো ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে। প্রবল শক্তিসম্পন্ন এ ঝড়ে বাংলাদেশে সবেচেয়ে বেশি ক্ষয়-ক্ষতির শিকার হয় চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, নোয়াখালী, খুলনা, বরিশাল ও পটুয়াখালীর উপকূলীয় অঞ্চল এবং সমুদ্র তীরবর্তী দ্বীপসমূহ ।
সাইক্লোন বা জলোচ্ছ্বাস
সাইক্লোন বা জলোচ্ছ্বাস বাংলাদেশের অন্যতম ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ হিসেবে পরিচিত। বিশেষ করে দেশের দক্ষিণাঞ্চলে প্রায় প্রতি বছরই জলোচ্ছ্বাস দেখা যায়। এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত ১৮৫ বছরে বাংলাদেশে মোট ৫১টি সাইক্লোন আঘাত হেনেছে। এর মধ্যে ১৯৭০ সালের ঘূর্ণিঝড়টি ছিল সবচেয়ে ভয়াবহ। ওই সময় বাতাসের গতিবেগ ছিল প্রায় ২৫০ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টা, এবং এর ধ্বংসযজ্ঞে প্রাণ হারান পাঁচ লাখেরও বেশি মানুষ। এই দুর্যোগ দেশের ইতিহাসে একটি বিভীষিকাময় স্মৃতি হয়ে আছে।
১৯৮৫ সালেও বাংলাদেশের দক্ষিণের দ্বীপাঞ্চলে হানা দেয় সর্বনাশা সাইক্লোন। সাইক্লোনের প্রচণ্ড আঘাতে উড়ির চর এলাকা বিধ্বস্ত হয়। এ সময়ে প্রায় দেড় লাখের মতো লোক প্রাণ হারায় এবং ধ্বংস হয় জমির ফসল ও অসংখ্য ঘরবাড়ি । ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল বাংলাদেশের দক্ষিণ অঞ্চলে সংঘটিত হয় স্মরণকালের আরও এক ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস। বাংলাদেশের ১৬টি জেলার প্রায় ৪৭টি থানা বিধ্বস্ত হয়।
২০ হাজার বর্গমাইল এলাকা জুড়ে এই ঝড় হ্যারিকেনের রূপ নিয়ে ২০ ফুটেরও বেশি উচ্চতায় জলোচ্ছ্বাস আঘাত হানে। ঐ প্রলয়ঙ্করী জলোচ্ছ্বাসে প্রায় পাঁচ লাখ লোক মারা যায়। এক পরিসংখ্যানে জানা প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকার সম্পদ এই দানবীয় প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিনষ্ট হয়েছে। সম্প্রতি আইলা, সিডর প্রভৃতি দুর্যেঅগে এ ক্ষতির পরিমাণ আরো বেশি হয়।
নদীভাঙন
বাংলাদেশে প্রতিবছর নদীভাঙনের ফলে বসতভিটা, ফসলি জমি নদীর বুকে বিলীন হয়ে যায়। লক্ষ লক্ষ লোক নির্মমতার কবলে পড়ে সহায়-সম্বলহীন হয়ে গ্রাম থেকে শহরে আশ্রয় নেয় ।
অনাবৃষ্টি বা খরা
বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ। এ দেশের কৃষিব্যবস্থা সম্পূর্ণ প্রকৃতির ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু প্রকৃতির হেয়ালিপনার শিকার এ দেশ প্রায় প্রতিবছরই অনাবৃষ্টি বা খরার মতো মারাত্মক প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পতিত হয়। খরার তীব্র তাপদাহে মাঠ- ঘাট ফেটে চৌচির হয়ে যায়। বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে সংঘটিত খরার প্রকোপে ব্যাপক ফসলাদি নষ্ট হয় ও জনজীবন অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে। খরার হিংস্র থাবার ফলে দেখা দেয় খাদ্যাভাব ও বিভিন্ন রোগ-শোক ।
টর্নেডো
বাংলাদেশে প্রায় বছরই টর্নেডো বা আকস্মিক ঘূর্ণিবায়ু মারাত্মকভাবে আঘাত হানে। ২০০৪ সালের এপ্রিল মাসে স্মরণকালের ইতিহাসে ভয়াবহতম টর্নেডো আঘাত হানে বাংলাদেশের নেত্রকোনা জেলা ও তার আশেপাশের জেলাগুলোতে। এতে বহু প্রাণহানি ঘটে। ধ্বংস হয় অসংখ্য ঘরবাড়ি। বিনষ্ট হয় হাজার হাজার গবাদিপশু।
লবণাক্ততা
লবণাক্ততাও একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ। বাংলাদেশের সমুদ্র উপকূলীয় জমিতে প্রায় সময়ই লবণাক্ততা দেখা দেওয়ার ফলে ব্যাপকভাবে ফসলের ক্ষতি হয়।
শিলাবৃষ্টি
শিলাবৃষ্টি বাংলাদেশের একটি সাধারণ কিন্তু ক্ষতিকর প্রাকৃতিক দুর্যোগ। প্রায় প্রতি বছরই দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রচণ্ড শিলাবৃষ্টি হয়, যার ফলে নানা ধরনের ফসল, বিশেষ করে ধান, মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ইরি ধানের মৌসুমে যদি শিলাবৃষ্টি হয়, তাহলে কৃষকদের দুঃখ-দুর্দশা বেড়ে যায়। ধান যদি চারা অবস্থায় থাকে, তবে ফলন অনেক কমে যায়। আর ধান বের হওয়ার পর শিলাবৃষ্টি হলে ধান চিটা হয়ে যায় বা ঝরে পড়ে, যা কৃষকের কষ্টের ফসল একেবারে নষ্ট করে দেয়।
ভূমিকম্প
বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রায় প্রতিবছর ভূমিকম্প হয়। এতে কিছু পরিমাণ জনজীবন বিপর্যস্ত হয় এবং দালান কোঠা, ঘরবাড়ি ধসে যায়। অনেক সময় ধ্বসে যাওয়া ঘরবাড়ির নিচে চাপা পড়ে মানুষ ও গরু ছাগল প্রাণ হারায় ।
অতিবৃষ্টি
কৃষিপ্রধান দেশে অতিবৃষ্টির ক্ষতিকর দিক কম নয়। বাংলাদেশে প্রায় বছরই অতিবৃষ্টির প্রকোপ দেখা দেয়। অতিবৃষ্টির ফলে ফসলের জমি পানিতে ডুবে যায়, কিংবা জমি থেকে পানি নিষ্কাশন দেরিতে হয়। এতে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়ে থাকে ।
বন্যা
প্রতিবছর বাংলাদেশের এক বিস্তৃর্ণ ভূ-ভাগ বন্যায় প্লাবিত হয়। ঋতুগত কারণে, নদ-নদীর পানি বেড়ে যাবার ফলে প্রবল বৃষ্টিপাতের ফলে পাহাড়ি ঢল নেমে, নদীর বাঁধ ভাঙে, জলোচ্ছ্বাস ও জোয়ারের ফলে বাংলাদেশে বন্যা দেখা দেয়। বন্যায় প্রাণহানি কম হলেও সম্পদ ও ফসলের ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি হয়। অনেক গবাদিপশু মারা যায়। বন্যাপরবর্তী সময়ে খাদ্যাভাব এবং নানারকম রোগব্যাধি দেখা দেয় । গৃহহীন হয়ে পড়ে অনেক লোক ।
নদীর গভীরতা হ্রাস
প্রতিবছর নদীসমূহের তলদেশে পলি জমে গভীরতা হ্রাস পায়। এতে নদীর পানি ধারণ ক্ষমতা কমে যায়। এ অবস্থায় নদীগুলোর সংস্কার করা জরুরি। কিন্তু পর্যাপ্ত সংস্কার ব্যবস্থা না থাকায় বৃষ্টি হলেই নদীর দু’কূল প্লাবিত হয়ে বন্যার সৃষ্টি হয়।
উজানের পানি
বাংলাদেশ ভাটির দেশ। বাংলাদেশ, নেপাল ও ভারতের প্রায় ১০ লাখ বর্গমাইল এলাকার পানি বাংলাদেশের প্রধান ৩টি নদী পদ্মা, মেঘনা ও ব্রহ্মপুত্র দিয়ে বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়। প্রতিবছর উজান থেকে প্রায় ১০ লাখ কিউসেক পানি নদীগুলোতে আসে। পানির এ প্রবল চাপেও বন্যার সৃষ্টি হয়।
বায়ুমণ্ডলের ওজোন স্তর হ্রাস
পৃথিবীর উপরে বায়ুমণ্ডলের যে স্তর রয়েছে তা ক্ষীণতর হয়ে আসায় সূর্যরশ্মি আগের চেয়ে বেশি প্রবলভাবে পৃথিবীকে আঘাত করছে এবং তপ্ত করে তুলছে। এতে বরফ গলা বৃদ্ধি পাচ্ছে। অপরদিকে বরফ গলার দরুন সমুদ্রের পানির স্তরও উপরের দিকে ওঠে যাচ্ছে। ফলে বন্যার সৃষ্টি হয়।
ভারত কর্তৃক সৃষ্ট সমস্যা
অনেকের মতে, বাংলাদেশে ভয়াবহ বন্যার একটি প্রধান কারণ হলো ভারতের ফারাক্কা বাঁধ। ভারত উজানের প্রায় সব নদীতেই বাঁধ নির্মাণ করে পানি সরিয়ে নেওয়ায় নদীগুলোর স্বাভাবিক প্রবাহ কমে যায় এবং এতে পলি জমে নদীর গভীরতা বা নাব্যতা হ্রাস পায়। অন্যদিকে, বর্ষাকালে যখন ভারতের পক্ষ থেকে হঠাৎ সব বাঁধের গেট খুলে দেওয়া হয়, তখন অতিরিক্ত পানির প্রবাহ সৃষ্টি হয়। এ প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করা নদীগুলোর পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ে, ফলে দ্রুত প্লাবন ঘটে এবং বন্যা দেখা দেয়।
অমসৃণ নদী পথ
বাংলাদেশের নদীগুলোর গতিপথ অমসৃণ। কোথাও মোটা, কোথাও চিকন। আবার অধিকাংশ নদীর গতিপথ খুব আঁকাবাঁকা। ফলে পানি প্রবাহে বিঘ্ন ঘটে। তাছাড়া অধিকাংশ নদনদী ও খালের উপর ব্রীজ, কালভার্ট ইত্যাদি নির্মিত হওয়ায়ও নদীর পানি প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়। ফলে বন্যার সৃষ্টি হয়।
দুর্যোগ মোকাবেলার উপায়
বিভিন্ন উপায়ে এসব দুর্যোগ মোকাবিলা করা যায়। দুর্যোগ মোকাবিলার প্রধান প্রধান উপায়গুলো নিম্নরূপ –
১.দুর্যোগ মোকাবেলার জন্য প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মীবাহিনী গঠন করা ।
২. জাতীয় ভিত্তিতে দুর্যোগ মোকাবিলা করার নীতিমালা, পরিকল্পনা ও কর্মপদ্ধতি প্রণয়ন করা।
৩. জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে বিভিন্ন সংস্থার কার্যক্রমের মধ্যে যোগাযোগ ও সমন্বয়ের ব্যবস্থা করা।
৪. পরীক্ষিত পদ্ধতির ভিত্তিতে যথাসময়ে সতর্কবাণী দেওয়ার ব্যবস্থা করা।
৫. দুর্যোগ ঘটার পর দ্রুত ক্ষয়ক্ষতি ও চাহিদা নিরূপণের ব্যবস্থা করা। ৬. তথ্য সরবরাহের ব্যবস্থাকে উন্নত করা ।
৭. দুর্যোগপূর্ণ এলাকাতে আশ্রয়স্থল গড়ে তোলা ।
৮. বেসামরিক ও সামরিক বাহিনীকে কাজে লাগানো ।
৯. বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাসমূহকে কাজে লাগানো।
১০. সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনকে কাজ করার সুযোগ দানের ব্যবস্থা গ্রহণ করা এবং
১১. শিক্ষার মাধ্যমে গণসচেতনতা সৃষ্টি করা ইত্যাদি ।
উপসংহার
প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেকোনো দেশের জন্য অভিশাপস্বরূপ। প্রাকৃতিক দুর্যোগ একদিকে যেমন জান-মালের ক্ষতি করে অন্যদিকে দেশের অর্থনীতিকেও বিপর্যস্ত করে। তাই বিশ্বের প্রতিটি দেশেরই উচিত দুর্যোগ মোকাবিলা করার জন্য সরকারি ও ক বেসরকারিভাবে বাস্তবসম্মত ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করা। কিন্তু শুধু প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ দ্বারা কখনো দুর্যোগ মোকাবিলা সম্ভব নয়, তাই এ সকল উদ্যোগ বাস্তবায়নে আমাদের সকলকে দৃঢ়চিত্তে সমানভাবে এগিয়ে আসতে হবে ।
আপনি যদি আরও রচনা পড়তে চান, তাহলে আমাদের ওয়েবসাইট StudyTika.com ভিজিট করুন। এখানে অনেক সহজ ও সুন্দর রচনা আছে। পড়ে দেখুন, ভালো লাগবে!