বাংলাদেশের জাতীয় কবি : কাজী নজরুল ইসলাম রচনা Class 7 8 9 10 ‍SSC HSC (২০+ পয়েন্ট)

এই ব্লগপোস্টে রয়েছে “বাংলাদেশের জাতীয় কবি : কাজী নজরুল ইসলাম” রচনাটি। সহজ ভাষায় লেখা এই রচনাটি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পড়লে অনেক উপকার হবে।

বাংলাদেশের জাতীয় কবি : কাজী নজরুল ইসলাম রচনা Class 7 8 9 10 ‍SSC HSC (২০+ পয়েন্ট)

বাংলাদেশের জাতীয় কবি : কাজী নজরুল ইসলাম রচনা 

ভূমিকা : বাংলা কাব্য-সাহিত্যের অঙ্গনে কবি নজরুল একটি বিস্ময়কর নাম। তিনি তাঁর কাব্য-সাধনার মাধ্যমে বাংলা কাব্যে নিনাদিত করেছেন মৃত্যুঞ্জয়ী চির-যৌবনের জয়ধ্বনি, অগ্নিবাণীর সুর-ঝঙ্কার। তিনি বাংলা কাব্যে বয়ে এনেছেন কালবৈশাখীর ঝড়, প্রমত্ত প্রভঞ্জনের বেসামাল আলোড়ন, এবং পরাধীন জড়তাগ্রস্ত সমাজের বুকে সঞ্চারিত করেছেন তপ্ত শোণিত-ধারা। তাঁর কবিতাগুলো পরাধীন ভারতের অবদমিত জনগণের জন্য সঞ্জীবনী মন্ত্র। তাঁর সংগীতগুলো নিপীড়িত, শোষিত, সর্বহারার বেদনার বাণী। নজরুলের আগে কোন কবি স্বকীয় বৈশিষ্ট্য নিয়ে সে অঙ্গনে প্রবেশ করতে সমর্থ হয় নি। এ সময় নজরুলই একমাত্র কবি যিনি সম্পূর্ণ রবীন্দ্র-প্রভাব-মুক্ত হয়ে স্বকীয় কাব্য-বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল হয়ে বাংলার সাহিত্য অঙ্গনে আবির্ভূত হন। 

জন্ম ও বংশ পরিচয় : কাজী নজরুল ইসলাম ১৮৯৯ সালে ২৪ মে (১১ জ্যৈষ্ঠ ১৩০৬) পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার চুরুলিয়া গ্রামে এক পীর বংশে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম কাজী ফকির মোহাম্মদ, মাতার নাম জাহেদা খাতুন; তাঁদোর চার পুত্রের অকাল মৃত্যুর পর নজরুলের জন্ম হওয়ায় তাঁর নাম রাখা হয় ‘দুখু মিয়া’। কাজী নজরুলের পূর্বপুরুষরা ছিলেন বিহার প্রদেশের অধিবাসী। আসানসোলে এঁরা কাজীর (বিচারক) দাযিত্ব পালন করতেন। নজরুল বাল্যকালেই পিতামাতাকে হারান। 

কৈশোর ও প্রথম যৌবন : পিতামাতাকে হারিয়ে কিশোর নজরুল নিদারুণ দারিদ্র্যে পতিত হন এবং অভিভাবকহীন অবস্থায় চরম অসহায়তার মুখোমুখি হন। এই সময় তিনি একটি লেটো গানের দলে যোগ দেন এবং সেখানেই গান রচনা ও সুরারোপের মাধ্যমে তাঁর প্রতিভার প্রথম প্রকাশ ঘটে। এরপর জীবিকা নির্বাহের জন্য তিনি কখনো মাংসের দোকানে, কখনো রুটির দোকানে অল্প বেতনে কাজ করেন। পরে চাকরি ছেড়ে দিয়ে তিনি সিয়ারসোল উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে পড়াশোনা শুরু করেন। ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে নজরুল পড়াশোনা ছেড়ে বাঙালি পল্টনে যোগ দেন। সেনাবাহিনীতে দক্ষতার স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি ‘হাবিলদার’ পদে উন্নীত হন। সৈনিক হিসেবে তাঁকে পেশোয়ার থেকে মেসোপটেমিয়া পর্যন্ত যাত্রা করতে হয়, যার ফলে তিনি বিভিন্ন দেশের সংস্কৃতি ও জীবনের সঙ্গে পরিচিত হন এবং অভিজ্ঞতা লাভ করেন। যুদ্ধশেষে সেনাবাহিনী থেকে অবসর নিয়ে তিনি কলকাতায় ফিরে আসেন। যুদ্ধক্ষেত্রের ট্রেঞ্চে বসেই তিনি রচনা করেন তাঁর বিখ্যাত কবিতা ‘মুক্তি’, যা পরবর্তীতে কলকাতার একটি পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এরপর নজরুল বাংলার কাব্যাঙ্গনে এক বিদ্রোহী সত্তা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। পুরাণ, কোরআন, গীতা, মহাভারতের গভীর জ্ঞান এবং আরবি, ফারসি, সংস্কৃত ও বাংলা ভাষার বিপুল শব্দভাণ্ডার ছিল তাঁর দখলে। পাশাপাশি সংগীতে তাঁর ছিল অগাধ পান্ডিত্য ও দুর্দান্ত প্রতিভা। পার্সি গজল গানেও তিনি ছিলেন অনন্য। তাঁর নাট্যপ্রেমও ছিল উল্লেখযোগ্য—তিনি যাত্রাপালায় একজন দক্ষ অভিনেতা হিসেবে নিজে অভিনয় করতেন এবং নিজের সুরারোপিত গানগুলো নিজেই পরিবেশন করতেন। শিশুদের জন্যও তিনি রচনা করেছেন অসংখ্য ছড়া ও কবিতা, যার মধ্যে ‘খুকু ও কাঠবেড়ালি’, ‘লিচু চোর’, ‘বীরপুরুষ’, ‘বাবুরাম সাপুড়ে’, ‘বাবুদের তাল পুকুরে’ প্রভৃতি এখনো শিশুদের মুখে মুখে ফেরে। আমাদের ছোটবেলায় কবিতার হাতে খড়ি হয় তাঁর কবিতা দিয়ে- 

‘ভোর হল, দোর খোল, খুকুমণি ওঠ রে! 
ঐ ডাকে জুঁইশাখে ফুলখুকী ছোটে রে!’ 

জাগরণ ও যৌবনের কবি : নজরুল ছিলেন জাগরণ ও যৌবনের কবি। তিনি কবিতা ও গানের মাধ্যমে জড় জনগণকে জাগাতে চাইলেন, তাই তিনি অজস্র গান ও কবিতা রচনা করে চললেন। তাঁর গান ও কবিতার বাণী ও ছন্দে জাগরিত হল পরাধীন দেশের চেতনা-শূন্য জনগণ, -বিশেষ করে যুবশক্তি। কবি বিদ্রোহী-চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ভেঙে ফেলতে চাইলেন শোষণ-শাসনের শৃঙ্খল, মুক্ত করতে চাইলেন চির-বঞ্চিত নিপীড়িত জনগণকে। তাঁর কবিতার ছন্দ দোলায় দুলে উঠল সমগ্র দেশ দেশবাদী শুনতে পেল তাঁর কবিতার মুক্তির বাণী। দেশের মাটিতে ফিরে এসে নজরুল দেখলেন পরাধীনতার অভিশাপে সারা দেশ জর্জরিত। ধনিত শ্রেণী ও সাম্রাজ্যবাদীদের সীমাহীন শোষণে সমগ্র সমাজে রচিত হয়েছে কংকালাকীর্ণ এক বিশাল শশ্মনভূমি। তখন তিনি লিখলেন- 

‘কারার ঐ লৌহকপাট 
ভেঙ্গে ফেল কররে লোপাট 
রক্ত-জমাট শিকল-পূজার পাষাণ-দেবী।’ 

‘বিদ্রোহী’ কবিতায় বজ্রকণ্ঠে ঘোষিত হল- 

‘আমি বেদুইন, আমি চেঙ্গিস 
আমি আপনারে ছাড়া করি না কাহারে কুর্ণিশ।’ 

বিদ্রোহের বাণী-সমৃদ্ধ তাঁর ‘অগ্নিবীণা’, ‘বিষের বাঁশি’, ‘সর্বহারা’, ‘ফণিমনসা’ প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থগুলো অত্যাচার, অবিচার, অনাচার ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ খড়গ অভিযানের সামিল, -বিদ্রোহের সোচ্চার জয়ধ্বনি। তাঁর কণ্ঠে যেভাবে বিদ্রোহের বাণী উচ্চারিত হয়েছে বাংলা সাহিত্যে তার তুলনা নেই। তাঁর বিদ্রোহী কণ্ঠের দৃপ্ত উচ্চারণ- 

‘বল বীর - বল উন্নত মম শির 
শির নেহারি আমারি, নত শির ওই শিখর হিমাদ্রির।’ 

কারাবরণ : দেশের সেবায় তিনি আত্মত্যাগ করতেও প্রস্তুত ছিলেন। বিদেশি ইংরেজ শাসক নজরুলের কাব্যের তাৎপর্য উপলব্ধি করে তাঁকে কারাগারে প্রেরণ করেন। তিনি কারাগারে বসেই বাহু অগ্নিক্ষরা কবিতা ও গান রচনা করেন। এতে আপামর জনসাধারণ এক নতুন জগতের স্বাদ গ্রহণ করে। নজরুল দেশকে ভালোবেসেছেন অন্তর দিয়ে। প্রচণ্ড অত্যাচার সহ্য করেছেন, তবুও জন্মভূমির এতটুকু অসম্মানও সহ্য করেন নি। স্বদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য রূপমুগ্ধ কবির লেখনীতে ফুটে উঠেছে- 

‘একি অপরূপ রূপে মা তোমায় হেরিনু পল্লী-জননী। 
ফুলে ও ফসলে কাদা মাটি জলে ঝলমল করে লাবণী।’ 

হিন্দু-মুসলমানের মৈত্রী কামনা : কবি নজরুল হিন্দু-মুসলমানকে সমান চোখে দেখতেন এবং এই দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে অটুট মৈত্রী কামনা করতেন। ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে হিন্দু-মুসলমান সাম্প্রদায়িক বিরোধ ও দাঙ্গার বিরুদ্ধে তাঁর শক্তিশালী কলমকে হাতিয়ার করেন। তিনি লিখলেন, ‘কাণ্ডারী হুঁশিয়ার’, ‘পথের দিশা’, ‘হিন্দু-মুসলিম যুদ্ধ’ ইত্যাদি সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী কবিতা। তাঁর বলিষ্ঠ লেখনী থেকে বেরিয়ে এলো চিরন্তন সত্য- 

‘হিন্দু না ওরা মুসলিম? ওই জিজ্ঞাসে কোন জন? 
কাণ্ডারী, বল, ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মার।’ 

এভাবে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে সম্প্রীতির মিলন-মন্ত্র রচনা করে গেছেন নজরুল। তিনি বুঝেছিলেন যে, হিন্দু-মুসলমানের মিলিত শক্তি ব্যতিরেকে কোনদিনই ইংরেজদের হাত থেকে স্বাধীনতা লাভ করা সম্ভব নয়। তাই তিনি সর্বাগ্রে চেয়েছেন হিন্দু-মুসলমানের মিলন ও প্রীতির বন্ধন। 

সাম্য ও মানবতার কবি নজরুল ইসলাম : নজরুলকে বলা হয় সাম্যের কবি, মানবতার কবি। তাঁর চোখে নারী-পুরুষ ছিল সমান। নারী-পুরুষের সাম্য নিয়ে তিনি লিখেছেন- 

‘সাম্যের গান গাই- 
আমার চক্ষে পুরুষ-রমণী কোনো ভেদাভেদ নাই! 
বিশ্বে যা-কিছু মহান সৃষ্টি চির-কল্যাণকর, 
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।’ 

তাঁর কাব্যের সর্বত্রই তিনি নিপীড়িত, শোষিত, লাঞ্ছিত জীবনের জয়গান গেয়েছেন। গণমানুষের কবি নজরুল মানুষের স্থানকে নির্দেশ করেছিলেন সবার ওপরে। ঘোষণা করেছিলেন : 

‘মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান।’ 

তাঁর সর্বহারা কাব্যের প্রতিটি কবিতায় গণমানুষের দুঃখ দর্দশার ছবি পতিস্ফুট এবং তাদের প্রতি তাঁর অপরিসীম দরদ বোধের পরিচয় মেলে। তিনি ‘সাম্যবাদী’ কবিতায় বলেন- 

‘গাহি সাম্যের গান-
যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা-ব্যবধান’।

‘কুলিমজুর’ কবিতায়-

‘এমনি করে কি জগৎ জুড়িয়া মার খাবে দুর্বল?’ 

নজরুল অন্যায়ের বিরুদ্ধে কলম ধরেছেন, অসাম্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছেন, জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে মানবতা, মুক্তি ও সাম্যের গান গেয়েছেন। তাঁর কবিতা ও গান বাঙালিকে নতুন চেতনায় উজ্জীবিত করেছিলেন। তাঁর গান ছিল আমাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণা। তাঁর ‘চল্ চল্ চল্’ গানটি বাংলাদেশের রণ সঙ্গীত। 

নজরুলের সাহিত্য সম্ভার : নজরুল অসংখ্য কবিতা ও গান রচনা করে বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে অগ্নিবীণা, বিষের বাঁশি, সাম্যবাদী, সর্বহারা ইত্যাদি। অন্যদিকে উপন্যাস, ছোটগল্প ও প্রবন্ধ রচনায় তিনি কম কৃতিত্ব দেখাননি। তাঁর লেখা বাঁধন হারা, মৃত্যুক্ষুধা, ব্যথার দান, রিক্তের বেদন প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। নজরুল ছিলেন বাংলা গজল গানের স্রষ্টা। 

উপসংহার : কবি নজরুল যখন সাধনার শীর্ষে ঠিক তখনই অর্থাৎ ১৯৪১ সালে তিনি বাক্শক্তি হারিয়ে ফেলেন এবং হারানো বাক্শক্তি তিনি আর ফিরে পান নি। এর ফলে নজরুলের চির-বিদ্রোহী সত্ত্বার অপমৃত্যু ঘটে। বহুভাবে তাঁর চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছিল, কিন্তু তাতে কোন ফল হয় নি। এ-অবস্থায় দীর্ঘদিন জীবন ধারণ করে দারুণ অর্থ কষ্টের নাগপাশে বন্দী থেকে জীবন-মৃত অবস্থায় কাল কাটাতে থাকেন। বাংলাদেশের স্বাধীন হওয়ার পর এই বিশ্বনন্দিত প্রিয় কবিকে কলকাতা থেকে ঢাকায় আনা হয় এবং ডি.লিট. উপাধিতে ভূষিত করা হয়। তিনি ঢাকাতেই পিজি হাসপাতালে ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট তারিখে ৭৭ বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁর মৃত্যুতে দেশের আপামর জনসাধারণ শোকে অভিভূত হয়ে পড়েন। 

“মসজিদেরই পাশে আমার কবর দিও ভাই”

-তাঁর এ গানের তাৎপর্য অনুসরণ করে তাঁর মরদেহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদের পাশে সমাহিত করা হয়। এখানেই তিনি চিরনিদ্রায় চিরশান্তিতে শায়িত আছেন। এই অমর কবিকে উপমহাদেশ তথা বিশ্ব সম্মানের সাথে স্মরণ করে।


আপনারা রচনাটি মন দিয়ে পড়েছেন, ধন্যবাদ। আরও অনেক সুন্দর রচনা পড়তে ভিজিট করুন আমার ওয়েবসাইট — StudyTika.com।

Getting Info...

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Oops!
It seems there is something wrong with your internet connection. Please connect to the internet and start browsing again.