ভূমিকা: এই ব্লগপোস্টে রয়েছে একটি সুন্দর ও সহজ রচনা – “গ্রীন হাউজ প্রতিক্রিয়া”। সবাইকে অনুরোধ করছি রচনাটি পুরোটা মন দিয়ে পড়তে।
গ্রীন হাউজ প্রতিক্রিয়া রচনা ১
ভূমিকা : পরিবেশ মানব সভ্যতার এক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। সভ্যতার ক্রমবিকাশ থেকেই মানুষ ধীরে ধীর গড়ে তুলেছে তার পরিবেশ। মানুষের রচিত পরিবেশ তারই সভ্যতার বিবর্তন ফসল। মানুষ নিজের প্রয়োজনে প্রকৃতিকে যেমন কাজে লাগাচ্ছে বা প্রাকৃতিক সম্পদকে ব্যবহার করছে, প্রকৃতিও তেমনি ছিন্ন-ভিন্ন-আহত রূপ নিয়ে মানুষের তথা সমগ্র প্রাণপুঞ্জের ঠিক সমপরিমাণ বিরোধিতা করতে তৎপর। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বিজ্ঞানের বিজয় গৌরবে মোহান্ধ মানুষ পৃথিবীর পরিবেশকে বিষাক্ত করেছে। আজও করছে। ছড়িয়ে দিয়েছে ক্ষতিকর সব আবর্জনা। তার ফল হয়েছে বিষময়। পরিবেশ দূষিত হয়েছে। তার দূষিত পরিবেশ প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট করছে। তাই গোটা জীবজগতের অস্তিত্বই আজ বিপন্ন। একবিংশ শতাব্দীর সন্ধিক্ষণে মানবজাতি যখন সভ্যতার চরম শিখরে, ঠিক তখনই পরিবেশ আমাদেরকে ঠেলে দিচ্ছে মহাবিপর্যয়ের দিকে। পরিবেশে দেখা দিয়েছে ‘গ্রীন হাউস প্রতিক্রিয়া’। বিশ্বব্যাপী এ নিয়ে চিন্তা ভাবনার অন্ত নেই। পরিবেশের এই বিপর্যয়ের জন্যে মূলত আমরাই দায়ী।
গ্রীন হাউজ প্রতিক্রিয়া কী? : গ্রীন হাউস কথাটির আভিধানিক অর্থ হল সবুজ ঘর, কার্যত এটি হচ্ছে কাঁচঘর, অর্থাৎ এর দেয়াল ও ছাদ কাঁচ নির্মিত; ফলে ঘরের ভেতরে আলো সহজে প্রবেশ করতে পারে। আলো প্রবেশ করায় ঘরের ভেতরের উষ্ণতা বৃদ্ধি পায় এবং তা কাঁচের দেয়ালের জন্যে বাইরে বেরিয়ে যেতে পারে না। ফলে কাঁচের ঘরটি কৃত্রিমভাবে গরম থাকে এর তাপমাত্রাও বাহিরের তাপমাত্রার চেয়ে বেশি হয়। বিশেষ ধরনের এই কাঁচের তৈরি ঘরকে বলা হয় গ্রীন হাউস।
পৃথিবীকে ঘিরে ভূপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার উপরে ওজোন স্তর রয়েছে, তবে এই স্তরের ঘনত্ব সব জায়গায় সমান নয়। প্রায় ২৩ কিলোমিটার উচ্চতায় এ স্তরের ঘনত্ব তুলনামূলকভাবে কম। সেখানে কার্বন-ডাইঅক্সাইডসহ আরও কিছু গ্যাসের একটি স্তর থাকে, যেগুলো একত্রে গ্রীন হাউস গ্যাস নামে পরিচিত। এই গ্যাসগুলো একটি রাসায়নিক পর্দার মতো কাজ করে, যা গ্রীন হাউসের কাঁচের দেয়ালের মতো ভেতরের তাপ বাইরে ছড়াতে বাধা দেয়। এর ফলে পৃথিবীর তাপমাত্রা জীবদের বসবাসের উপযোগী থাকে। জীবের বসবাসের এই অনুকূল পরিস্থিতিকে গ্রীন হাউস প্রতিক্রিয়া বলা হয়।
গ্রীন হাউস প্রতিক্রিয়ার কারণ : গ্রীন হাউস প্রতিক্রিয়ার ধ্বংসযজ্ঞের কথা ভেবে বিজ্ঞানীরা আজ অঙ্কিত। বিজ্ঞানীরা মাত্রাতিরিক্ত জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও মানুষের অপরিকল্পিত কর্মকাণ্ডকে গ্রীন হাউস প্রতিক্রিয়ার প্রধান কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। মাত্রাতিরিক্ত জনসংখ্যার চাহিদা মেটাতে নগরায়ন প্রক্রিয়া বেড়েছে, চলাচলের জন্য যানবাহন বেড়েছে, কর্মসংস্থানের জন্য অপরিকল্পিতভাবে কল-কারখানা স্থাপন করা হচ্ছে। অধিক জনসংখ্যার নগরায়ন সুবিধার জন্য গাছপালা ও বনভূমি নির্মূল করা হচ্ছে। যার ফলে প্রকৃতিতে প্রয়োজনের তুলনায় অক্সিজেন হ্রাস পাচ্ছে এবং কার্বন-ড্রাইঅক্সাইড উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে, পরিবেশে কার্বন-ডাইঅক্সাইডের বৃদ্ধির ফলে বায়ুতে মিশ্রিত হচ্ছে ক্রোরোফ্লুরো কার্বন নামক অতীব ক্ষতিকর এক প্রকার গ্যাস। এ গ্যাস ধ্বংস করছে ছাকুনি হিসেবে অতি বেগুনি রশ্মি পরিশ্রুতকারী ওজোন স্তরকে। আর এ অবস্থা গ্রীন হাউস প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করছে। আবার অত্যধিক যানবাহনের কালো ধোঁয়া এবং যত্রতত্র স্থাপিত কল-কারখানার বিষাক্ত বর্জ্য ও ধোঁয়াও গ্রীন হাউস প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। অতিরিক্ত জনসংখ্যার খাদ্য চাহিদা মেটাতে অধিক ফসলের আশায় জমিতে কীটনাশক ও রাসায়নিক সার ব্যবহার করা হচ্ছে। কিন্তু এদের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার গ্রীন হাউস প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে। বৈজ্ঞানিক গবেষণা প্রসূত হাইড্রোজেন বোমা ও পারমাণবিক বিস্ফোরণের রাসায়নিক তেজস্ক্রিয়তাও গ্রীন হাউস প্রতিক্রিয়ার জন্যে দায়ী।
গ্রীন হাউস প্রতিক্রিয়ার প্রভাব : গ্রীন হাউস প্রতিক্রিয়ার ধ্বংসাত্মক প্রভাবে ভূপৃষ্ঠের অস্তিত্ব আজ হুমকির সম্মুখীন। গ্রীন হাউস প্রতিক্রিয়ার ফলে গ্রীন হাউস গ্যাস ও পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায়। ফলে বায়ুমণ্ডলের ওজোন স্তর দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এবং সাথে সাথে সূর্যের ক্ষতিকর বেগুনি রশ্মি সরাসরি ভূপৃষ্ঠে চলে আসছে। এতে মানুষের ক্যান্সার রোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে। গ্রীন হাউস প্রতিক্রিয়ায় মেরু অঞ্চলের বরফ গলা শুরু হওয়ায় সমুদ্রপৃষ্ঠের পানির উচ্চতা বৃদ্ধি পেয়ে ভূপৃষ্ঠের নিম্নাঞ্চল ডুবে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। তাছাড়া এর প্রভাবে বৃষ্টিপাত কমে গিয়ে মরু অঞ্চলের সৃষ্টি হচ্ছে। বন্যা, ঝড়, জলোচ্ছ্বাস এর ন্যায় প্রাকৃতিক দুর্যোগও গ্রীন হাউজ প্রতিক্রিয়ার ফল। আবহাওয়াবিদরা আশঙ্কা করছেন আগামী শতাব্দীর শেষভাগে পৃথিবীর সার্বিক আবহাওয়া মণ্ডলে ঘটবে ব্যাপক পরিবর্তন ও বড় ধরনের বিপর্যয়। সবচেয়ে বিপজ্জনক অবস্থা যা হবে, তা হচ্ছে- উচ্চ পর্বত শিখরে, মেরু অঞ্চলে পুঞ্জীভূত বরফ গলে সাগর ও মহাসাগরের পানি ফাঁপিয়ে তুলবে। তলিয়ে যাবে অনেক শহর, বন্দর ও জনপদ।
গ্রীন হাউজ প্রতিক্রিয়া ও বাংলাদেশ : গ্রীন হাউস প্রতিক্রিয়ার প্রভাবে দরিদ্র জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত বাংলাদেশ বর্তমানে একটি গুরুতর পরিবেশগত বিপর্যয়ের মুখে দাঁড়িয়ে। দেশটি উষ্ণমণ্ডলীয় অঞ্চলে অবস্থিত হওয়ায় প্রাকৃতিকভাবেই তাপমাত্রা তুলনামূলক বেশি। এর পাশাপাশি অতিরিক্ত জনসংখ্যার কারণে বসতি স্থাপনের জন্য গাছপালা ও বনভূমি নির্বিচারে কেটে ফেলা হচ্ছে, যার ফলে পরিবেশের তাপমাত্রা ধীরে ধীরে আরও বাড়ছে। এসব কারণে বাংলাদেশে যেসব গুরুতর সমস্যা দেখা দিতে পারে, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে ভূতাত্ত্বিক পরিবর্তনের ফলে মূল ভূখণ্ডের একটি বড় অংশ পানির নিচে তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা এবং লবণাক্ততার প্রসারসহ আরও নানা পরিবেশগত ঝুঁকি।
বিশ্বপরিবেশে গ্রীন হাউসের প্রতিক্রিয়া বা প্রভাব : পশ্চিম জার্মানির মারবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. জেনার হেবারের এক গবেষণায় উঠে এসেছে যে, অতিবেগুনি রশ্মির প্রভাব ইতোমধ্যে ৫% ছাড়িয়ে গেছে। এর ফলে অ্যান্টার্কটিকার ফাইটোপ্ল্যাঙ্কটন ভয়াবহভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যদি এই প্রবণতা এভাবেই চলতে থাকে, তাহলে দক্ষিণ গোলার্ধের সব জীব ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে এবং সেখান থেকে জীবের কোনো অস্তিত্ব আর খুঁজে পাওয়া সম্ভব নাও হতে পারে। জাপানের পরিবেশ সংস্থার এক রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০৩০ সালের মধ্যে গ্রীন হাউস প্রতিক্রিয়ার কারণে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা ১.৫০ থেকে ৩.৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বেড়ে যেতে পারে। এর ফলে বরফ ও হিমবাহ গলে সমুদ্রের পানির উচ্চতা প্রায় দেড় মিটার পর্যন্ত বাড়তে পারে বলে পরিবেশ বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা করছেন। এতে পৃথিবীর প্রায় অর্ধেক মানুষ সরাসরি আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে পড়বে। বিশেষ করে সার্কভুক্ত বাংলাদেশ ও মালদ্বীপসহ বিশ্বের সমুদ্র উপকূলবর্তী বিস্তীর্ণ জনপদ ভয়াবহ বিপর্যয়ের সম্মুখীন হবে—এটি এখন আর কল্পনা নয়, বাস্তবতা।
গ্রীন হাউস প্রতিক্রিয়ার প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা : গ্রীন হাউস প্রতিক্রিয়া থেকে উদ্ভূত সমস্যাবলি মানবজাতির অস্তিত্বের জন্য এক বিরাট হুমকিস্বরূপ। এর ক্ষতিকর প্রভাব থেকে মুক্তির জন্য নিম্নোক্ত প্রতিকারমূলক ব্যবস্থাসমূহ গ্রহণ করা যায়।
১। অবাধে গাছপালা নিধন ও বনভূমি উজাড় করা বন্ধ করতে হবে।
২। পরিবেশ দূষণ কমানোর জন্য পরিকল্পিতভাবে কল-কারখানা স্থাপন করতে হবে এবং এগুলোর বর্জ্য নিষ্কাশনে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে।
৩। যানবাহনের বিষাক্ত কালো ধোঁয়া নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য কুটিপূর্ণ গাড়ির চলাচলে নিষেধাজ্ঞা জারি করতে হবে।
৪। বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও ভবিষ্যতে নিমজ্জিত হওয়া থকে ভূমিকে রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় বাঁধ নির্মাণ করতে হবে।
৫। সমুদ্রের লবণাক্ত পানি যাতে স্বাদু পানির জলাশয় ও নদীতে প্রবেশ করতে না পারে সে ব্যবস্থা নিতে হবে।
৬। গ্রীন হাউস পতিক্রিয়ার মারাত্মক প্রভাব বর্ণনা করে প্রচার মাধ্যমের সাহায্যে গণসচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে।
৭। প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত পাঠ্যসূচিতে গ্রীন হাউস প্রতিক্রিয়ার বিভিন্ন দিক তুলে ধরতে হবে।
উপসংহার : গ্রীন হাউস প্রতিক্রিয়া একটি আন্তর্জাতিক সমস্যা। আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ছাড়া গ্রীন হাউস প্রতিক্রিয়া রোধ করা মোটেই সম্ভব নয়। তাই এর ক্ষতিকর প্রভাব রোধকল্পে আন্তর্জাতিকভাবে এগিয়ে আসতে হবে এবং এর প্রতিক্রিয়া প্রতিরোধ ও প্রশমনের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।
আপনারা যদি এই রচনাটি ভালোভাবে পড়ে উপকার পান, তাহলে StudyTika.com-এ আরও অনেক সুন্দর ও সহজ রচনা রয়েছে—একবার দেখে আসুন!