বাংলাদেশের উপন্যাস নিয়ে সুন্দর একটি রচনা এই ব্লগপোস্টে দেওয়া হয়েছে। সহজ ভাষায় লেখা, পড়তে ভালো লাগবে। একবার পড়া শুরু করলে শেষ পর্যন্ত পড়তেই ইচ্ছা করবে।
বাংলাদেশের উপন্যাস রচনা
নতুন ধরনের গদ্যকাহিনী উপন্যাস নামে গড়েউঠল-যার মূল উপাদান হলাে মানুষেরবাস্তব জীবন, তার নানা সমস্যা,সংশয়, নানাভাব, কল্পনা, আদর্শের বিচিত্র সমারােহ।–ড. অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়
ভূমিকা : বর্তমান যুগে উপন্যাস সাহিত্যের জনপ্রিয়তাই সবচেয়ে বেশি। এর সাহায্যে সমাজের সর্বস্তরের লােকের মনােরঞ্জন করা যেমন সুসাধ্য, তেমনি আর কোনােপ্রকার সাহিত্য শিল্পের দ্বারা হয় না বললেই চলে। বাংলাদেশের উপন্যাস হিসেবে নির্দিষ্ট সময়ের পরিধিতে যেসব গ্রন্থ রচিত হয়েছে তা বাংলা উপন্যাসের ঐতিহ্যেরই অনুসারী। বাংলা উপন্যাসের আদিযুগে মুসলমান ঔপন্যাসিকদের অবদান ছিল না। মুসলমানরা যখন উপন্যাস রচনায় সক্রিয় হয়ে উঠেন তখন বাংলা উপন্যাসের ধারা সমৃদ্ধির পথে অনেক দূর অগ্রসর হয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশের উপন্যাস যথেষ্ট সমৃদ্ধি লাভ করেছে।
উপন্যাসের সংজ্ঞা : উপন্যাসের সঠিক সংজ্ঞা নির্ধারণ করা কিছুটা জটিল। মূলত, উপন্যাস হলো জীবনের একটি সমালোচনা বা বিশ্লেষণ। ডক্টর শ্রী কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “সামাজিক সংজ্ঞা হলো মানুষের মধ্যে চলমান আকর্ষণ-বিকর্ষণের দ্বন্দ্বের সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ, এবং এই দ্বন্দ্ব ও সংঘাতের মাধ্যমে মানুষের জীবন সম্পর্কে একটি বৃহৎ ও গভীর সত্য প্রকাশ পায়—এই রচনাই উপন্যাস।” শ্রীশচন্দ্র দাশ তাঁর ‘সাহিত্য সন্দর্শন’ গ্রন্থে লিখেছেন, “লেখকের ব্যক্তিগত জীবনদর্শন ও অভিজ্ঞতা নিয়ে কোনো বাস্তব কাহিনীকে অবলম্বন করে যে বর্ণনামূলক সাহিত্যকর্ম রচিত হয়, সেটিই উপন্যাস বলা হয়। ঔপন্যাসিকের প্রধান দায়িত্ব হলো গল্পটিকে সুন্দর ও সুরসালভাবে বর্ণনা করা। কেউ কেউ উপন্যাসকে ‘পকেট থিয়েটার’ বা ‘ক্ষুদ্র নাট্যরূপ’ বলেও অভিহিত করেন। নাটকে যেমন রঙগম ও দৃশ্যাবলী কাজ করে, উপন্যাসে তেমনি কাজটি বর্ণনার মাধ্যমে সম্পন্ন হয়।
বাংলা উপন্যাসের সূচনা : ইউরােপে রেনেসাঁসের ফলে লােকভাষার শ্রীবৃদ্ধি হয় এবং সেই ভাষায় মানুষের গল্প রচিত হয়ে জনচিত্তকে রঞ্জিত করে। ষােড়শ সপ্তদশ শতকেই সারা ইউরােপে দেশীয় ভাষায় অনেক গদ্য কাহিনী রচিত হয়েছিল, কিন্তু ঠিক উপন্যাস বলতে যা বােঝায়, তার জন্যে অষ্টাদশ শতকের প্রয়ােজন ছিল। ইংরেজি সাহিত্যে সমাজ ও পরিবারকে কেন্দ্র করে যুগান্তকারী উপন্যাস রচিত হলাে উনিশ শতকে। তারপর কাল অগ্রসর হয়েছে, সমাজ, রাষ্ট্র, পরিবেশ বদলাতে শুরু করেছে, মানুষে মানুষে সম্পর্ক জটিলতর হয়েছে, মনের মধ্যে জট পাকিয়ে উঠেছে। বিশ শতকের ইউরােপীয় উপন্যাসে সেই জটিলতা নানা ধরনের বৈচিত্র্য সৃষ্টি করেছে।
বাংলা উপন্যাসের উৎপত্তির মূলে আছে ইংরেজি উপন্যাসের প্রভাব। অবশ্য মধ্যযুগের ধর্মপ্রধান কাব্যসাহিত্যের অন্তরালেও মানবজীবন কাহিনীর অস্তিত্ব ছিল। মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যে মঙ্গলকাব্যে বাস্তব কাহিনীর অভাব নেই। মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর চণ্ডীমঙ্গলের কাহিনীতে কিছু কিছু উপন্যাসের লক্ষণ
আছে বটে, কিন্তু যথার্থ উপন্যাস উনিশ শতকের মাঝামাঝি প্রথম রচিত হতে আরম্ভ করে এবং বলাই বাহুল্য ইংরেজি আদর্শকে শিরােধার্য করে। বাংলা ভাষায় প্রথম উপন্যাস রচনা করেন প্যারীচাদ মিত্র ওরফে টেকচাঁদ ঠাকুর। তাঁর উপন্যাসের নাম ‘আলালের ঘরের দুলাল’ (১৮৫৮)। কিন্তু কালগত দিক থেকে উপন্যাস হিসেবে প্রথম গ্রন্থের দাবি খ্রিস্টান বিদেশিনী হ্যানা ক্যাথারিন ম্যালেন্স রচিত ‘ফুলমনি ও করুণার বিবরণ’ (১৮৫২)। খ্রিস্টধর্মের মাহাত্ম প্রচারের জন্যে এই গ্রন্থ রচিত হয়েছিল বলে বাঙালি সমাজে তেমন সমাদর পায় নি। যথার্থ উপন্যাসের স্রষ্টা বঙ্কিচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। ১৮৬৫ সালে প্রকাশিত তাঁর ‘দুর্গেশনন্দিনী’ বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক উপন্যাস হিসেবে গৌরবােজ্জ্বল ইতিহাসের সূচনা করে।
বাংলাদেশের উপন্যাসের বৈশিষ্ট্য : নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে উন্নতির পথে এগোচ্ছে এখানকার উপন্যাস, যার ফলে এটি নতুন ধরনের বৈশিষ্ট্যের বহনকারী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। বর্তমান বাংলাদেশের স্বতন্ত্র প্রকৃতি ও জীবনধারা ১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগের আগে এই উপন্যাসে রূপায়িত হওয়ার সুযোগ পায়নি। তবে এরপর বাংলাদেশের জীবনে নতুন চেতনার সঞ্চার ঘটে এবং আলাদা রাষ্ট্র হিসেবে জীবনের গতিপ্রকৃতি বিভিন্ন দিক থেকে বৈচিত্র্যময়ভাবে প্রবাহিত হতে শুরু করে। গ্রামবাংলার বহুমাত্রিক জীবন যেমন উপন্যাসে প্রতিফলিত হয়েছে, তেমনি শহরকেন্দ্রিক জীবনের নানা সমস্যা-দুঃখ-কষ্টও এতে স্থান পেয়েছে। দেশ বিভাগের পর রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতিতেও পরিবর্তন আসে এবং তার প্রভাব মানুষের দৈনন্দিন জীবনে প্রতিফলিত হয়। বাংলাদেশের ঔপন্যাসিকগণ এই বৈচিত্র্যময় জীবনকেই সফলভাবে উপন্যাসের মাধ্যমে উপস্থাপন করতে সক্ষম হয়েছেন। এখানকার উপন্যাসে গ্রামীণ জীবন, নগরজীবন, আঞ্চলিক জীবনচিত্র, মনস্তত্ত্ব, ঐতিহাসিক চেতনা সহ বিভিন্ন বিষয় স্থান পেয়েছে। এই বৈচিত্র্যময় বিষয়বস্তুকে সামনে রেখে ‘বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত’ গ্রন্থে মুহম্মদ আবদুল হাই উল্লেখ করেছেন, “একদিকে কৃষিভিত্তিক পল্লিজীবন, অন্যদিকে আধুনিক দ্বন্দ্বে ভরা নাগরিক জীবন; একদিকে পূর্ববঙ্গের ঐশ্বর্যময় প্রকৃতির বর্ণনা, অন্যদিকে আধুনিক মানুষের জটিল অন্তর মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ; একদিকে প্রাচীন ঐতিহ্যের প্রতি আকর্ষণ, অন্যদিকে রোমান্টিক কল্পনার বিলাসিতা; একদিকে স্বাধীনতা সংগ্রামের উত্তেজনাপূর্ণ পটভূমিতে মানুষের অস্থিরতা, অন্যদিকে হৃদয়াবেগপূর্ণ প্রেমের চিরন্তন চিত্র—এসবই আমাদের বাংলা উপন্যাসে স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়েছে।
বাংলাদেশের উপন্যাস : ইংরেজি ও বাংলা উভয় সাহিত্যেই উপন্যাস অপেক্ষাকৃত আধুনিক সৃষ্টি। সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশের উপন্যাসের ধারা যথেষ্ট সমৃদ্ধ হয়েছে। পল্লিজীবন ও নাগরিক জীবন ছাড়াও যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের উপন্যাসে মুক্তিযুদ্ধের যথেষ্ট প্রতিফলন লক্ষ করা যায়। স্বাধীনতা সংগ্রামের পটভূমিতে এখানকার জীবনে যে প্রবল আলােড়ন সৃষ্টি হয়েছিল তা প্রত্যক্ষদর্শী ঔপন্যাসিকগণ উপেক্ষা করতে পারেন নি। তাই বাংলাদেশের উপন্যাসে মুক্তিযুদ্ধের চিত্রাঙ্কনের সঙ্গে সঙ্গে যুদ্ধোত্তরকালের জীবনের রূপায়ণেরও নিদর্শন প্রকাশিত হচ্ছে। প্রবীণ ও নবীন ঔপন্যাসিকবৃন্দ বাংলাদেশের উপন্যাস সাহিত্যের বিকাশের সঙ্গে জড়িত।
প্রবীন ঔপন্যাসিকদের মধ্যে প্রথমেই আবুল মনসুর আহমদের নাম উল্লেখ করা যায়। রস রচনায় অভূতপূর্ব খ্যাতি অর্জন করলেও উপন্যাসের ক্ষেত্রে তাঁর কৃতিত্ব কম নয়। ‘সত্যমিথ্যা’, ‘আবেহায়াত’, ‘জীবনক্ষুধা’ প্রভৃতি উপন্যাসে আবুল মনসুর আহমদ আদর্শবাদিতার পরিচয় দিয়েছেন। আবুল কালাম শামসুদ্দীনের প্রধান পরিচয় সাংবাদিক হলেও ‘খরতরঙ্গ’ ও ‘ত্রিস্রোতা' উপন্যাস লিখে বিশিষ্টতার পরিচয় দিয়েছেন। ‘মােমেনের জবাববন্দী’ মাহবুব-উল-আলমের বিখ্যাত আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস। তার অন্যান্য উপন্যাস হলাে ‘গাঁয়ের মায়া’ ও ‘মফিজন’।
আবুল ফজল বাংলা সাহিত্যের নানা শাখায় অবদান রেখেছেন। উপন্যাসের ক্ষেত্রেও তাঁর কৃতিত্ব কম নয়। ‘চৌচির’, ‘সাহসিকা', 'জীবন পথের যাত্রী’, ‘প্রদীপ ও পতঙ্গ’, ‘রাঙ্গাপ্রভাত’ প্রভৃতি আবুল ফজলের উপন্যাস। সমকালীন জীবনের সমস্যা প্রতিফলিত হয়েছে তাঁর উপন্যাসগুলােতে। এসময়ের একজন শক্তিশালী ঔপন্যাসিক সত্যেন সেন। তাঁর উপন্যাসের মধ্যে আছে ‘ভােরের বিহঙ্গী’, ‘অভিশপ্ত নগরী’, ‘পদচিহ্ন’, ‘পাপের সন্তান’, ‘মা’, ‘অপরাজেয়’, ‘শহরের ইতিকথা’, ‘আলবেরুনী’, উত্তরণ’, ‘সেয়ানা’, ‘পুরুষমেধ’, ‘বিদ্রোহী কৈবর্ত’, ‘সাত নম্বর ওয়ার্ড’ ইত্যাদি। খান মুহম্মদ মঈনুদ্দীন নাম করেছেন নয়া সড়ক উপন্যাস রচনা করে। ‘আলাের পরশ’ আবুল হাশেম খানের বিখ্যাত উপন্যাস। ইতিহাসভিত্তিক এ উপন্যাসের জন্যে তিনি বাংলা একাডেমী পুরস্কার লাভ করেছেন। এসময়ের অন্যান্য ঔপন্যাসিকদের মধ্যে কাজী আবুল হােসেন, আশরাফুজ্জামান, মবিনউদ্দিন আহমদ ও আহসান হাবীব অন্যতম।
আবু জাফর শামসুদ্দিন অত্যন্ত শক্তিশালী ঔপন্যাসিক। বাংলা কথাসাহিত্যে তিনি বৈচিত্র্যধর্মী প্রতিভার পরিচয় দিয়েছেন। ঔপন্যাসিক হিসেবে বাংলাদেশের সাহিত্যের তার একটি বিশিষ্ট স্থান রয়েছে। ‘পদ্মা মেঘনা যমুনা’ তার ইতিহাসভিত্তিক সুবৃহৎ উপন্যাস। আবু জাফর শামসুদ্দিনের অন্যান্য উপন্যাসের মধ্যে ‘পরিত্যক্ত স্বামী’, ‘মুক্তি’, ‘ভাওয়াল গড়ের উপাখ্যান’, ‘সংকর সংকীর্তন’, ‘প্রব’, ‘দেয়াল’ উল্লেখযােগ্য।
শওকত ওসমান বাংলাদেশের খ্যাতিমান কথাশিল্পী। সাহিত্যের নানা শাখায় তার পদচারণা থাকলেও ঔপন্যাসিক হিসেবেই তাঁর খ্যাতি সবচেয়ে বেশি। ‘জননী’, ‘বনি আদম’, ‘ক্রীতদাসের হাসি’, ‘সমাগম’, ‘বেড়ী', 'দুই সৈনিক’, ‘ক্ষুদে সােশ্যালিস্ট’, ‘চৌরসন্ধি’, ‘জাহান্নাম হতে বিদায়’, ‘রাজা উপাখ্যান’ প্রভৃতি তাঁর উপন্যাস। এসময়ের অন্যান্য ঔপন্যাসিকদের মধ্যে আকবর হােসেন, দৌলতুন্নেসা খাতুন, আবু রুশদ, শামস্ রশীদ, কাজী আফসারউদ্দিন আহমদ, নীলিমা ইব্রাহীম অন্যতম।
বাংলাদেশের কথাসাহিত্যে সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ অসামান্য অবদান রেখেছেন। তিনি খ্যাতি অর্জন করেছেন ‘লালসালু’ উপন্যাস লিখে। বাংলাদেশের সাহিত্যে যেসব উপন্যাস প্রবল আলােড়ন সৃষ্টি করেছিল তার মধ্যে ‘লালসালু’ অন্যতম। উপন্যাসটি রচিত হয়েছে গ্রামীণ জীবনের পটভূমিকা নিয়ে। এতে গ্রামবাংলার বাস্তবচিত্র প্রাণবন্তরূপে ফুটে উঠেছে। ‘চাদের অমাবস্যা’ ও ‘কাদো নদী কাঁদো’ তাঁর অন্যান্য উপন্যাস। সরদার জয়েনউদ্দীন যথার্থ প্রতিভার পরিচয় দিয়েছেন ‘আদিগন্ত’, ‘নীল রং রক্ত’, 'অনেক সূর্যের আশা’, ‘পান্নামােতি’, ‘বেগম শেফালী মির্জা, বিধ্বস্ত রােদের ঢেউ’, শ্রীমতী ক খ এবং শ্রীমান তালেব আলী’, ‘কদম আলীদের বাড়ি’ প্রভৃতি উপন্যাস লিখে। ইসহাক চাখারী, বেদুঈন সামাদ, রশীদ করিম এসময়ের অন্যান্য শক্তিশালী ঔপন্যাসিক।
আবু ইসহাক অভূতপূর্ব খ্যাতিলাভ করেছেন 'সূর্য দীঘল বাড়ী' উপন্যাস লিখে। গ্রামবাংলার দরিদ্র মানুষের অর্থনৈতিক সংকটের পরিপ্রেক্ষিতে স্বার্থপর মানুষের অত্যাচার নিপীড়নের বাস্তবচিত্র নিয়ে এটি একটি বিশিষ্ট সামাজিক উপন্যাস। ক্ষয়িষ্ণু সামন্ততান্ত্রিক আভিজাত্য, অবক্ষয়ী গ্রাম্য জীবন ও আধুনিক শহরকেন্দ্রিক জীবনের জৌলুসের পটভূমিতে ‘কন্যা কুমারী’ উপন্যাস লিখে খ্যাতি অর্জন করেছেন আবদুর রাজ্জাক।
শামসুদ্দীন আবুল কালাম কথাসাহিত্যে অসামান্য অবদান রেখেছেন। সাধারণ মানুষের জীবনচিত্র তাঁর উপন্যাসে চমৎকারভাবে ফুটেছে। ঐতিহাসিক পটভূমি নিয়েও তিনি উপন্যাস লিখেছেন। তাঁর উপন্যাসের মধ্যে ‘আশিয়ানা’, ‘জীবনকাব্য’, ‘আলম নগরের উপকথা’, ‘কাঞ্চনমালা’, ‘দই মহল’, ‘জায়জাল', ‘কাশবনের কন্যা’, ‘নবান্ন’, ‘সমুদ্র বাসর’, ‘যার সাথে যার’, ‘মনের মত ঠাই’ প্রভৃতি উল্লেখযােগ্য।
শহীদুল্লাহ কায়সার উপন্যাস লিখে দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। মাত্র দুটি উপন্যাস লিখে তিনি বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছেন মর্যাদার সাথে। তাঁর উপন্যাস দুটির নাম ‘সারেং বৌ’ ‘সংশপ্তক’। রােমেনা আফাজ অনেকগুলাে উপন্যাস রচনা করেছেন। তার মধ্যে ‘কাগজের নৌকা’, ‘সােনালী সন্ধ্যা’, ‘জানি তুমি আসবে’, ‘প্রিয়ার কণ্ঠস্বর’, ‘হারানাে মানিক’ প্রভৃতি উল্লেখযােগ্য। আনােয়ার পাশা, আনিস চৌধুরী, মেসবাহুল হক, মােহাম্মদ মাের্তজা, নাজমুল আলম, রাজিয়া মজিদ এসময়ের অন্যান্য ঔপন্যাসিক।
আলাউদ্দিন আল আজাদ সব্যসাচী লেখক। বাংলা সাহিত্যের নানা শাখায় তাঁর অবদান দৃষ্টান্তস্বরূপ । উপন্যাসের ক্ষেত্রে তিনি অভিনবত্বের পরিচয় দিয়েছেন। চট্টগ্রাম অঞলের উপজাতীয় জীবনচিত্র নিয়ে রচিত কর্ণফুলী তার শ্রেষ্ঠ উপন্যাস হিসেবে বিবেচিত। তাঁর অপর বিখ্যাত উপন্যাস ‘তেইশ নম্বর তৈলচিত্র’ বহু আন্তর্জাতিক ভাষায় অনূদিত হয়েছে। আলাউদ্দিন আল আজাদের অন্যান্য উপন্যাসের মধ্যে শীতের শেষ রাত বসন্তের প্রথম দিন’, ‘ক্ষুধা ও আশা’ প্রভৃতি উল্লেখযােগ্য।
জহির রায়হান বেশ কয়েকটি উপন্যাস রচনা করে প্রতিভার পরিচয় দিয়েছেন। হাজার বছর ধরে তার শ্রেষ্ঠ উপন্যাস। জহির রায়হানের অন্যান্য উপন্যাসগুলাে হলাে ‘শেষ বিকেলের মেয়ে’, ‘আরেক ফাল্গুন’, ‘বরফ গলা নদী’, ‘আর কত দিন’, ‘কয়েকটি মৃত্যু’ ও ‘তৃষ্ণা’। আবদুল গাফফার চৌধুরীর চন্দ্রদ্বীপের উপাখ্যান', ‘নাম না জানা ভাের’, ‘নীল যমুনা’, ‘শেষ রজনীর চাদ’ প্রভৃতি বিখ্যাত উপন্যাস। শহীদ আখন্দ খ্যাতি অর্জন করেছেন ‘পান্না হলাে সবুজ’, ‘পাখীর গান বনের ছায়া’, ‘দু'দণ্ড শান্তি’ প্রভৃতি উপন্যাস লিখে।
সৈয়দ শামসুল হক শক্তিশালী কথাসাহিত্যিক। খেলারাম খেলে যা' তাঁর বিখ্যাত ও জনপ্রিয় উপন্যাস। তাঁর অন্যান্য উপন্যাসের মধ্যে ‘এক মহিলার ছবি’, ‘দেয়ালের দেশ’, ‘সীমানা ছাড়িয়ে’, ‘দূরত্ব’, ‘কয়েকটি মানুষের সােনালী যৌবন’, ‘তুমি সেই তরবারী’, ‘এক যুবকের ছায়াপথ’, ‘বারাে দিনের শিশু’, ‘বনবালা কিছু টাকা ধার নিয়েছিল’, ‘কালধর্ম’, ‘নিষিদ্ধ লােবান’, নীলদংশন’ প্রভৃতি উল্লেখযােগ্য। রাবেয়া খাতুন, রাজিয়া খান, মকবুলা মনজুর, রাহাত খান এসময়ের অন্যান্য বিশিষ্ট ঔপন্যাসিক।
শওকত আলী একজন অত্যন্ত শক্তিশালী কথাসাহিত্যিক, যিনি ছোটগল্প ও উপন্যাস উভয় ক্ষেত্রে দারুণ দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। বর্তমান সময়ে তিনি অন্যতম শ্রেষ্ঠ ঔপন্যাসিক হিসেবে স্বীকৃত। তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘পিঙ্গল আকাশ’। শওকত আলীর অন্যান্য উল্লেখযোগ্য উপন্যাসের মধ্যে রয়েছে ‘যাত্রা’, ‘গন্তব্যে অতঃপর’, ‘আবার আসিব’, ‘ওয়ারিশ’, ‘দক্ষিণায়নের দিন’, ‘কুলায় কালস্রোত’ এবং ‘পূর্বরাত্রি পূর্বদিন’ প্রভৃতি। এছাড়া দিলারা হাসেম, রশীদ হায়দার, নূরুল ইসলাম খান, রিজিয়া রহমান, মাহমুদুল হক, সেলিনা হোসেন, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, হুমায়ূন আহমেদ, ইমদাদুল হক মিলন, মঞ্জু সরকার প্রমুখ অন্যান্য শক্তিশালী ঔপন্যাসিক এসময়ে সক্রিয় ছিলেন।
উপসংহার : সাম্প্রতিক বাংলা উপন্যাস মানেই আজকের জীবনের প্রতিচ্ছবি। অস্থির উত্তেজনাময় বিশ্বে অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার পরিপ্রেক্ষিতে মানুষ আজ সুস্থ ও শান্ত হয়ে জীবন অতিবাহিত করতে পারছে না, এই সংক্ষুব্দ জীবন চিন্তাই সাম্প্রতিক উপন্যাসের উপজীব্য বিষয়। গ্রামীণ জীবন, নাগরিক জীবন, আঞ্চলিক জীবনচিত্র, ঐতিহাসিক চেতনা, মনস্তত্ত্ব ইত্যাদি নানাদিক থেকে নতুনতর বৈশিষ্ট্য নিয়ে বাংলাদেশের উপন্যাসের যথেষ্ট অগ্রগতি এসেছে।
এই রচনাটি পড়ার জন্য ধন্যবাদ। এমন আরও অনেক সুন্দর ও সহজ রচনা পড়তে ভিজিট করুন আমার ওয়েবসাইট — StudyTika.com। এখানেই পাবেন আরও অনেক দরকারি রচনা।