এই পোস্টে দেওয়া হয়েছে একটি চমৎকার ভাবসম্প্রসারণ— "যে নদী হারায়ে স্রোত চলিতে না পারে, সহস্র শৈবালদাম বাঁধে আসি তারে"। সহজ ভাষায় উপস্থাপন করা এই ভাবসম্প্রসারণটি পড়লে আপনি এর গভীর অর্থ সহজে বুঝতে পারবেন। চলুন, পুরোটা মন দিয়ে পড়ে নিই।
যে নদী হারায়ে স্রোত চলিতে না পারে,সহস্র শৈবালদাম বাঁধে আসি তারে
মূলভাব : নদী যেখানে তার গতিধারা হারিয়ে ফেলে সেখানে শৈবালসহ নানা ধরনের লতাগুল্মের জন্ম হয়। তদ্রুপ, কোনো জাতি যখন অনগ্রসর এবং অলস অবস্থায় পতিত হয় তখন জাতির জীবনে আসে ধ্বংসাত্মক পরিণতি।
সম্প্রসারিত ভাব : নদীর প্রকৃতি চিহ্ন হয় তার প্রবাহমানতা দ্বারা। বহতা শক্তির অভাবই নদীর মৃত্যু। যে নদী নিরন্তর প্রবাহিত হয়, উৎস থেকে সমুদ্রসংগম পর্যন্ত সদাচঞ্চল স্রোতধারার দুই পার্শ্বে নতুন নতুন সভ্যতার বিকাশ সম্ভব করে, সে-নদী কোনো বাঁধা স্বীকার করে না। তার জলকল্লোলে দুর্জয় প্রাণের ঝংকার তার তরঙ্গধারায় যুক্ত জীবনের ছন্দোময়তা, তার গতিচাঞ্চল্যে বিঘ্নজয়ী দুর্বার বলিষ্ঠতা দৃশ্য হয়ে ওঠে। তাই নদী ‘চলার বেগে পালন-পারা, পথে পথে বাহির হয়ে আপন-হারা।’ কিন্তু স্তিমিত জলস্রোত নদীর গতিকে মন্থর করে, তার অঙ্গে অঙ্গে সমাচ্ছন্ন হয় শৈবাল, তার প্রাণধর্মের অবলুপ্তি ঘটে। নদীর প্রকৃতি ও জাতির ধর্ম সাদৃশ্যের সূত্রেই বিবেচ্য।
প্রাণবন্ত ও সজীব মানুষের জীবন যেমন চলমান থাকে, তেমনি একটি জাতির জীবনেও গতি থাকলে তাতে নতুন চিন্তা, শুদ্ধি ও সৃজনশীলতা আসে। স্বাধীন চিন্তাশক্তি, ন্যায়বোধ, সংস্কারমুক্ত মন ও বলিষ্ঠ কর্মপ্রবাহ জাতিকে সামনে এগিয়ে নিতে সাহায্য করে। এভাবেই জাতি তার নিজস্ব পরিচয় গড়ে তোলে, যা উন্নত সভ্যতার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে ওঠে। তবে সবসময় জাতির এই অগ্রগতি ধরে রাখা সম্ভব হয় না। অনেক সময় জাতির জীবন ধীর হয়ে পড়ে, তখন গড়ে ওঠে অপ্রয়োজনীয় কুসংস্কার ও রীতিনীতি। চিন্তার স্বাধীনতা হারিয়ে যায়, হারিয়ে যায় সৃজনশীলতা, সাহসিকতা ও সংগ্রামী মনোভাব। তখন মানুষ শুধু নিয়ম-কানুনের বাইরে কিছু ভাবতে ভয় পায়, বিবেক চাপা পড়ে, আর মানবিকতার কণ্ঠস্বর থেমে যায়। জাতির শক্তি ও অগ্রগতির ক্ষমতা হারিয়ে যায়, ফলে জাতি ধীরে ধীরে দুর্বল ও নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। এ অবস্থাই বলে দেয়, জাতির পতনের সময় ঘনিয়ে এসেছে। ইতিহাসে আমরা এমন অনেক জাতির কথা পাই, যারা একসময় গতি হারিয়ে স্থবির হয়ে পড়েছিল। তখন হয়তো একজন দুর্দান্ত নেতা এসে তাদের জাগিয়ে তুলেছেন, নতুবা তারা চিরতরে হারিয়ে গেছে ইতিহাসের অন্ধকারে।
স্থির জলের স্রোত যেখাবে নদীর গতিকে মন্থর করে, তেমনি কোনো জাতি চেতনা ও আদর্শ থেকে চ্যুত হলে বিভিন্ন ধরনের বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়।
এই ভাবসম্প্রসারণটি অন্য বই থেকেও সংগ্রহ করে দেয়া হলো
ভাব-সম্প্রসারণ : সৃষ্টিশীল যা কিছু দৃশ্যমান, তার সবকিছুই প্রবাহমান। চলমানতাই জীবনের বৈশিষ্ট্য, নিশ্চলতা মৃত্যু। স্থবিরতা ব্যক্তি ও সমাজজীবনকে যেমন স্তিমিত করে দেয়, জাতীয় জীবনকেও করে বিপর্যস্ত। ঐশ্বর্যমণ্ডিত ও সমৃদ্ধ জাতীয়-জীবনে তাই গতিশীলতার কোনো বিকল্প নেই।
নদীর গৌরব তার স্রোতধারার মধ্যে, স্রোতই নদীকে গতিশীলতা দান করে, তার বুকে ভরে দেয় পূর্ণতার সার্থকতা। সব ঝঞ্জাল, মালিন্য আর ক্লেদাক্ত আবর্জনা নদীর দুরন্ত গতিধারায় ভেসে চলে যায়। নদীর বহমান ধারায় প্রতি মুহূর্তে জলরাশি নিত্য-নতুন, কোনো পঙ্কিল বাধা তার জলকে মলিন করে তুলতে পারে না। সব মালিন্য ধৌত করে নদী আপন বেগে চির-চঞ্চল; উৎস থেকে মোহনার পূর্ণতার অভিমুখে নিত্য ধাবমান। এই নদীই তার গৌরব হারায় যখন কোনো কারণে তার বেগ মন্দীভূত হয়ে পড়ে, তার স্রোতধারা রুদ্ধ হয়ে যায়, তার গতি স্থির হয়ে যায়। তখন তার বুক শৈবাল বা আবর্জনায় ভরে ওঠে। তদ্রুপ, ব্যক্তিগত তথা সামাজিক জীবনে কোনো ব্যক্তি যদি স্থবির হয় তবে তার জীবনে উন্নতির আশা অবাস্তব কল্পনা ছাড়া আর কিছুই নয়। নদীর মতোই জাতির জীবনের পূর্ণতাও নির্ভর করে তার চলমানতার ওপর। অগ্রগমনই জাতির বিকাশোন্মুখের পরিচায়ক। যে জাতির স্বাভাবিক চলনধর্ম আছে, সে জাতিই নবীন সভ্যতাকে সহজে আত্মসাৎ করতে পেরেছে। সংকীর্ণ আচার-বিচার-সংস্কার সে জাতির গতিপ্রবাহকে রুদ্ধ করতে পারে না, সচলতার বেগেই সব বাধাকে অনায়াসে সে অতিক্রম করে যায়। স্বচ্ছন্দ ও নির্বাধ গতিতে এগোতে না পারলে জাতির আত্মবিকাশ ব্যাহত হয়। পদে পদে শাস্ত্রের অনুশাসন ও দেশাচারের বাধা-নিষেধ স্বতঃস্ফূর্ত বহমান জীবনধারাকে স্তব্ধ করে। চলমানতা হারিয়ে ফেলার অর্থই হল জাতির ভবিষ্যৎ উন্নয়নের সফল সম্ভাবনার অপমৃত্যু। জীবনে উন্নতির চাবিকাঠি হল সংস্কারমুক্ত হয়ে গতিময়-জীবনের দিকে অগ্রসর হওয়া। যে জাতি যতদিন উন্নয়নকামী ও কর্মঠ থাকে, ততদিন কোনোরূপ কুসংস্কার তার গতি রোধ করতে পারে না। কিন্তু সে-জাতি যদি তার পুরাতন ঐতিহ্যকে বুকে ধরে অগ্রগতির পথে না এগোয় তবে স্রোতহীন নদীর মতোই শত সংস্কার এসে তাকে ঘিরে ফেলে। ফলে ধীরে ধীরে সে এ-ধারা থেকে লয়প্রাপ্ত হয়। একইভাবে ব্যক্তিজীবনেও গতি ও চলমানতার গুরুত্ব অনেক বেশি। জীবন পথে এগিয়ে যেতে হলে সংগ্রাম ও চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়েই সাফল্য অর্জন করতে হয়। যারা পরিশ্রম করে, সাহস নিয়ে কাজ করে, তারাই জীবনে সফল হয় এবং সম্মানের আসনে পৌঁছায়। অন্যদিকে যারা অলস, কাজ করতে চায় না, যাদের জীবনে কোনো গতি নেই—তাদের বারবার ব্যর্থতার মুখোমুখি হতে হয়। তারা জীবনভর হতাশা আর দুঃখের মাঝে কাটিয়ে দেয়। এই ভাষাটি শিক্ষার্থীদের রচনা, অনুচ্ছেদ বা বক্তৃতায় ব্যবহারের জন্য উপযুক্ত। প্রয়োজনে আরও সংক্ষিপ্ত বা বিস্তারিত সংস্করণও দেওয়া যেতে পারে।
যে জাতির জীবনধারা অচল, অসার সে জাতির অপমৃত্যু অবশ্যম্ভাবী। গতিশীল জীবনপ্রবাহেই জাতীয় জীবনকে করে জীবন্ত ও উজ্জ্বল।
✦ উপসংহার: আশা করি ভাবসম্প্রসারণটি ভালো লেগেছে। এমন আরও সহজ ভাষায় লেখা ভাবসম্প্রসারণ পড়তে চাইলে ঘুরে আসুন আমার ওয়েবসাইটে— StudyTika.com। অনেক উপকারী ভাবসম্প্রসারণ সেখানে আপনার জন্য অপেক্ষা করছে!