শবে কদর, একটি এমন রাত যা হাজার মাসের চেয়েও উত্তম। এটি ভাগ্য নির্ধারণের রাত, যেখানে আল্লাহর অসীম রহমত ও ক্ষমার দরজা উন্মুক্ত থাকে। এই রাতে ইবাদত-বন্দেগি করা মুমিনদের জন্য অপার সওয়াব ও পুণ্যের সুযোগ। কুরআনে বর্ণিত দোয়া এবং রাসুলুল্লাহ (সা.) প্রদত্ত দোয়াগুলোর মাধ্যমে আমরা আল্লাহর কাছ থেকে ক্ষমা ও রহমত প্রার্থনা করতে পারি।
আপনি কি জানেন, এই রাতটি কেন এত গুরুত্বপূর্ণ? চলুন, বিস্তারিত জেনে নেই এবং শবে কদরকে নিজের জীবনের একটি স্মরণীয় ইবাদতের রাত হিসেবে গড়ে তুলি।
শবে কদরের দোয়া
শবে কদর হলো ভাগ্য নির্ধারণের রাত। এটি এমন একটি রাত যা পূর্বের গুনাহ থেকে মুক্তি পাওয়ার সুযোগ দেয় এবং হাজার মাসের চেয়েও উত্তম বলে গণ্য হয়। এই পবিত্র রাতে আল্লাহর কাছে বেশি বেশি দোয়া করুন এবং ইবাদতে মনোনিবেশ করুন।
আল্লাহ তাআলা কুরআনে বান্দার জন্য বহু দোয়া উল্লেখ করেছেন, যা প্রতিটি ইবাদতের সময় পড়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নিচে কিছু গুরুত্বপূর্ণ দোয়া উল্লেখ করা হলো:
১. সুরা মুমিনুন: আয়াত ১১৮
رَبِّ اغْفِرْ وَارْحَمْ وَأَنْتَ خَيْرُ الرَّاحِمِيْنَ
উচ্চারণ: রাব্বিগফির ওয়ারহাম ওয়া আংতা খাইরুর রাহিমিন।
অর্থ: হে আমার প্রভু! আমাকে ক্ষমা করুন এবং আমার উপর রহম করুন; আপনিই সর্বশ্রেষ্ঠ রহমকারী।
২. সুরা মুমিনুন: আয়াত ১০৯
رَبَّنَا آمَنَّا فَاغْفِرْ لَنَا وَارْحَمْنَا وَأَنتَ خَيْرُ الرَّاحِمِينَ
উচ্চারণ: রাব্বানা আমান্না ফাগফিরলানা ওয়ারহামনা ওয়া আংতা খাইরুর রাহিমিন।
অর্থ: হে আমাদের পালনকর্তা! আমরা বিশ্বাস স্থাপন করেছি। অতএব, আমাদের ক্ষমা করুন এবং আমাদের প্রতি রহম করুন।
৩. সুরা কাসাস: আয়াত ১৬
رَبِّ إِنِّيْ ظَلَمْتُ نَفْسِيْ فَاغْفِرْ لِيْ
উচ্চারণ: রাব্বি ইন্নি জ্বালামতু নাফসি ফাগফিরলি।
অর্থ: হে আমার প্রভু! আমি নিজের উপর জুলুম করেছি। আমাকে ক্ষমা করুন।
৪. সুরা আল-ইমরান: আয়াত ১৬
رَبَّنَا إِنَّنَا آمَنَّا فَاغْفِرْ لَنَا ذُنُوْبَنَا وَقِنَا عَذَابَ النَّارِ
উচ্চারণ: রাব্বানা ইন্নানা আমান্না ফাগফিরলানা জুনুবানা ওয়া ক্বিনা আজাবান নার।
অর্থ: হে আমাদের রব! আমরা ঈমান এনেছি। আমাদের গোনাহ ক্ষমা করুন এবং জাহান্নামের আযাব থেকে রক্ষা করুন।
৫. সুরা আরাফ: আয়াত ২৩
رَبَّنَا ظَلَمْنَا أَنْفُسَنَا وَإِنْ لَّمْ تَغْفِرْ لَنَا وَتَرْحَمْنَا لَنَكُونَنَّ مِنَ الْخَاسِرِيْنَ
উচ্চারণ: রাব্বানা জ্বালামনা আংফুসানা ওয়া ইল্লাম তাগফিরলানা ওয়া তারহামনা লানাকুনান্না মিনাল খাসিরিন।
অর্থ: হে আমাদের প্রভু! আমরা নিজেদের প্রতি জুলুম করেছি। যদি আপনি আমাদের ক্ষমা না করেন এবং আমাদের প্রতি দয়া না করেন, আমরা ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হব।
কুরআনে বর্ণিত এই দোয়াগুলো আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা এবং রহমত লাভের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই মুমিন মুসলমানদের উচিত ইবাদতের সময় এই দোয়াগুলো পড়া।
লাইলাতুল কদরের বিশেষ দোয়া
হজরত আয়েশা (রাদিয়াল্লাহু আনহা) থেকে বর্ণিত, তিনি রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে জিজ্ঞাসা করেছিলেন: যদি আমি জানতে পারি যে লাইলাতুল কদর কখন হবে, তখন কোন দোয়া করব?
রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) উত্তর দেন:
اللَّهُمَّ إِنَّكَ عُفُوٌّ تُحِبُّ الْعَفْوَ فَاعْفُ عَنِّي
উচ্চারণ: আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুয়্যুন; তুহিব্বুল আফওয়া; ফাফু আন্নি।
অর্থ: হে আল্লাহ! আপনি ক্ষমাশীল; ক্ষমা করতে ভালোবাসেন; অতএব আমাকে ক্ষমা করে দিন।
কুরআনে উল্লেখিত ক্ষমার দোয়া
- رَبِّ اغْفِرْ وَارْحَمْ وَأَنْتَ خَيْرُ الرَّاحِمِيْنَ
উচ্চারণ: রাব্বিগফির ওয়ারহাম ওয়া আংতা খাইরুর রাহিমিন।
অর্থ: হে আমার প্রভু! আমাকে ক্ষমা করুন এবং আমার উপর রহম করুন; আপনিই সর্বশ্রেষ্ঠ রহমকারী। - رَبَّنَا آمَنَّا فَاغْفِرْ لَنَا وَارْحَمْنَا وَأَنتَ خَيْرُ الرَّاحِمِينَ
উচ্চারণ: রাব্বানা আমান্না ফাগফিরলানা ওয়ারহামনা ওয়া আংতা খাইরুর রাহিমিন।
অর্থ: হে আমাদের পালনকর্তা! আমরা বিশ্বাস স্থাপন করেছি। আমাদের ক্ষমা করুন এবং আমাদের প্রতি রহম করুন। - رَبِّ إِنِّيْ ظَلَمْتُ نَفْسِيْ فَاغْفِرْ لِيْ
উচ্চারণ: রাব্বি ইন্নি জ্বালামতু নাফসি ফাগফিরলি।
অর্থ: হে আমার প্রভু! আমি নিজের উপর জুলুম করেছি, আমাকে ক্ষমা করুন।
দোয়ার নাম | দোয়া (আরবি) | উচ্চারণ | অর্থ |
---|---|---|---|
সুরা মুমিনুন: আয়াত ১১৮ | رَبِّ اغْفِرْ وَارْحَمْ وَأَنْتَ خَيْرُ الرَّاحِمِيْنَ | রাব্বিগফির ওয়ারহাম ওয়া আংতা খাইরুর রাহিমিন। | হে আমার প্রভু! আমাকে ক্ষমা করুন এবং আমার উপর রহম করুন; আপনিই সর্বশ্রেষ্ঠ রহমকারী। |
সুরা মুমিনুন: আয়াত ১০৯ | رَبَّنَا آمَنَّا فَاغْفِرْ لَنَا وَارْحَمْنَا وَأَنتَ خَيْرُ الرَّاحِمِينَ | রাব্বানা আমান্না ফাগফিরলানা ওয়ারহামনা ওয়া আংতা খাইরুর রাহিমিন। | হে আমাদের প্রভু! আমরা বিশ্বাস স্থাপন করেছি। আমাদের ক্ষমা করুন এবং আমাদের প্রতি রহম করুন। |
সুরা কাসাস: আয়াত ১৬ | رَبِّ إِنِّيْ ظَلَمْتُ نَفْسِيْ فَاغْفِرْ لِيْ | রাব্বি ইন্নি জ্বালামতু নাফসি ফাগফিরলি। | হে আমার প্রভু! আমি নিজের উপর জুলুম করেছি। আমাকে ক্ষমা করুন। |
লাইলাতুল কদরের দোয়া | اللَّهُمَّ إِنَّكَ عُفُوٌّ تُحِبُّ الْعَفْوَ فَاعْفُ عَنِّي | আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুয়্যুন; তুহিব্বুল আফওয়া; ফাফু আন্নি। | হে আল্লাহ! আপনি ক্ষমাশীল; ক্ষমা করতে ভালোবাসেন; অতএব আমাকে ক্ষমা করে দিন। |
লাইলাতুল কদরের আরো কিছু দোয়া
হজরত আয়েশা (রাদিয়াল্লাহু আনহা) বর্ণনা করেন, তিনি রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, "হে আল্লাহর রাসুল! আমি যদি জানতে পারি যে, এটি লাইলাতুল কদর, তাহলে আমি কী দোয়া করব?"
রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছিলেন, "তুমি বলবে":
اللَّهُمَّ إِنَّكَ عُفُوٌّ تُحِبُّ الْعَفْوَ فَاعْفُ عَنِّي
উচ্চারণ: আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুয়্যুন; তুহিব্বুল আফওয়া; ফাফু আন্নি।
অর্থ: হে আল্লাহ! আপনি ক্ষমাশীল; ক্ষমা করতে ভালোবাসেন; অতএব আমাকে ক্ষমা করে দিন।
এই দোয়া মুসনাদে আহমাদ, ইবনে মাজাহ, তিরমিজি এবং মিশকাতে বর্ণিত হয়েছে।
শবে কদরের নামাজ পড়ার নিয়ম
শবে কদরের রাতে নফল নামাজ দু‘রাকাত করে যত বেশি পড়া যায়, তত বেশি সওয়াব অর্জন করা সম্ভব। প্রতিটি রাকাতে সূরা ফাতিহা পড়ার পর সূরা ইখলাস, সূরা কদর, আয়াতুল কুরসী অথবা সূরা তাকাছুর ইত্যাদি সূরা মিলিয়ে পড়া অত্যন্ত ফজিলতপূর্ণ। কমপক্ষে ১২ রাকাত নামাজ আদায় করা উত্তম। এর বেশি পড়া সম্ভব হলে তা আরও সওয়াবের কারণ হবে।
যদি উল্লেখিত সূরাগুলো পড়তে না পারেন, তবে আপনি সূরা ফাতিহার পর আপনার জানা অন্য যেকোনো সূরা প্রতিটি রাকাতে মিলিয়ে পড়তে পারেন।
এর পাশাপাশি শবে কদরের রাতে সালাতুল তাওবা, সালাতুল হাজত এবং সালাতুল তাসবিহ নামাজ আদায় করাও অনেক ফজিলতের কাজ। রাতের শেষ ভাগে অন্তত ৮ রাকাত তাহাজ্জুদ নামাজ পড়ার চেষ্টা করা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
শবে কদরের নামাজের নিয়ত
আরবীতে: “নাওয়াইতুআন্ উছল্লিয়া লিল্লা-হি তা‘আ-লা- রাক‘আতাই ছালা-তি লাইলাতুল কদর-নাফলি, মুতাওয়াজ্জিহান ইলা-জিহাতিল্ কা‘বাতিশ্ শারীফাতি আল্লা-হু আকবার।”
বাংলায়: “আমি ক্বেবলামূখী হয়ে আল্লাহ্ এর উদ্দেশ্যে শবে কদরের দু‘রাক‘আত নফল নামাজ আদায়ের নিয়ত করলাম- আল্লাহু আকবার।”
শবে কদরের রাতে করণীয়
রমজান মাসে রাসুলুল্লাহ (সা.) এর ইবাদতের মাত্রা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেত। বিশেষ করে শেষ দশকে তিনি প্রায় পুরো রাত জেগে ইবাদতে মগ্ন থাকতেন।
হযরত আয়েশা (রা.) বলেন, “যখন রমজানের শেষ ১০ রাত এসে যেত তখন রাসূল (সা.) রাত জাগরিত থাকতেন, তার পরিবারের সদস্যদের জাগিয়ে দিতেন, অত্যন্ত উদ্দীপনার সঙ্গে ইবাদত-বন্দেগিতে রত থাকতেন এবং পারিবারিক ও দাম্পত্য কাজকর্ম বন্ধ করে দিতেন।” (বুখারী ও মুসলিম)
বিশেষ দোয়া
এ রাতে রাসূলুল্লাহ (সা.) হযরত আয়েশা (রা.)-কে বিশেষ একটি দোয়া শিক্ষা দিয়েছেন। দোয়াটি হলো:
“আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুউউন তুহিব্বুল আফওয়া ফা’ফু আন্নি।” (তিরমিজি)
শবে কদরের ফজিলত
যে ব্যক্তি মাগরিব, এশা ও ফজরের নামাজ জামাতের সাথে আদায় করবে, সে শবে কদরের একটি অংশ পাবে। আর যে ব্যক্তি এ রাত থেকে বঞ্চিত, সে হাজারো কল্যাণ ও বরকত থেকে বঞ্চিত। (ইবনে মাজাহ)
শবে কদর কোন রাতে?
আমাদের সমাজে ‘লাইলাতুল কদর’ বা ‘শবে কদর’ ২৭ রমজানে পালন করা হলেও ইসলামী শরিয়তের বিধান অনুযায়ী, রমজানের শেষ দশকের বেজোড় রাতে শবে কদর অনুসন্ধানের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
এ রাতটি পাওয়ার জন্য রাসূলুল্লাহ (সা.) শেষ দশকের ইবাদতের নিয়তে মসজিদে ইতেকাফ করতেন। এতে শবে কদর থেকে বঞ্চিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকত না।
শবে কদরের ফজিলত
শবে কদর এমন একটি মহিমান্বিত রাত, যা হাজার মাসের ইবাদতের চেয়েও শ্রেষ্ঠ। এই রাতে যথাযথ ইবাদত করলে আল্লাহ তাআলা বান্দার গুনাহ মাফ করেন এবং জান্নাতের দরজা উন্মুক্ত করেন।
প্রত্যেক মুমিনের কর্তব্য হলো এই রাতে ইবাদতে মগ্ন থাকা এবং আল্লাহর কাছে বেশি বেশি দোয়া করা। আল্লাহ আমাদের সবাইকে শবে কদরের বরকত ও ফজিলত লাভ করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
শবে কদর আমাদের জীবনে এক মহা সুযোগ। এই রাতে দোয়া ও ইবাদতের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের চেষ্টা করা উচিত। আপনার জীবনে শবে কদরের বরকত পেতে হলে কুরআনে বর্ণিত দোয়া এবং রাসুলুল্লাহ (সা.) প্রদত্ত দোয়াগুলো পড়ুন এবং নিয়মিত ইবাদতে মনোযোগ দিন।
আমাদের ওয়েবসাইট Studytika.com-এ এ ধরনের আরও গুরুত্বপূর্ণ আর্টিকেল রয়েছে। সেগুলো পড়ুন এবং নিজের জ্ঞানকে সমৃদ্ধ করুন। আল্লাহ আমাদের সবাইকে এই রাতের বরকত দান করুন। আমিন।