রাতে ঘুমানোর দোয়া (সঠিক দোয়া)

রাতে ঘুমানোর দোয়াঃ ঘুম মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে এক অনন্য নিয়ামত। এটি শুধু আমাদের শরীরের ক্লান্তি দূর করে না, বরং নতুন দিনের কাজের জন্য শক্তি যোগায়। ইসলামে ঘুম সম্পর্কিত কিছু বিশেষ দোয়া এবং করণীয়-বর্জনীয় নিয়ম রয়েছে, যা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে কল্যাণ বয়ে আনতে পারে। এই ব্লগে আমরা ঘুম সম্পর্কিত ইসলামের সুন্নত, দোয়া, এবং সঠিক পদ্ধতির কথা বিস্তারিত আলোচনা করবো। আশা করি, এই পোস্টটি আপনাকে ঘুমের গুরুত্ব ও সঠিক পদ্ধতি সম্পর্কে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি দেবে।
রাতে ঘুমানোর দোয়া (সঠিক দোয়া)

ঘুমানোর দোয়া বাংলায়

যে মুহূর্তের দোয়া দ্রুত কবুল করেন আল্লাহ, তা হলো:

ঘুমানোর আগের দোয়া

اَللَّهُمَّ بِاسْمِكَ أَمُوتُ وَأَحْيَا (আল্লাহুম্মা বিসমিকা আমুতু ওয়া আহইয়া)
অর্থ: ‘হে আল্লাহ! আমি তোমারই নামে ঘুমাই এবং তোমার নামেই জাগ্রত হই।’

হজরত হুজাইফাহ (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রাতের বেলায় নিজ বিছানায় শোয়ার (ঘুমানোর আগে) সময় নিজ গালের নিচে হাত রাখতেন আর এই দোয়া পড়তেন।’ (সহিহ বুখারি : ৩৩১৪)

ঘুম থেকে জাগার পরের দোয়া

لْحَمْدُ لِلَّهِ الَّذِي أَحْيَانَا بَعْدَ مَا أَمَاتَنَا وَإِلَيْهِ النُّشُورُ (আলহামদু লিল্লাহিল্লাজি আহইয়া না বা’দা মা আমা তানা ওয়া ইলাইহিন নুশূর)
অর্থ: ‘সমস্ত প্রশংসা সেই আল্লাহর, যিনি ঘুমের পর আমাদের জাগ্রত করেছেন এবং আমাদের তার কাছেই ফিরে যেতে হবে।’

আবার যখন মহানবী (সা.) ঘুম থেকে সজাগ হতেন, তখন এই দোয়া বলতেন। (বুখারি : ৬৩১২)

বিষয় তথ্য
ঘুমানোর আগের দোয়া اَللَّهُمَّ بِاسْمِكَ أَمُوتُ وَأَحْيَا
অর্থ: হে আল্লাহ! আমি তোমারই নামে ঘুমাই এবং তোমার নামেই জাগ্রত হই।
ঘুম থেকে জাগার পরের দোয়া الْحَمْدُ لِلَّهِ الَّذِي أَحْيَانَا بَعْدَ مَا أَمَاتَنَا وَإِلَيْهِ النُّشُورُ
অর্থ: সমস্ত প্রশংসা সেই আল্লাহর, যিনি ঘুমের পর আমাদের জাগ্রত করেছেন এবং আমাদের তার কাছেই ফিরে যেতে হবে।
রাতে ঘুমানোর সুন্নত
  • রাতে দেরি করে না ঘুমানো।
  • একাকি ঘরে না ঘুমানো।
  • খোলা আকাশের নিচে না ঘুমানো।
  • পবিত্র হয়ে শোয়া।
সুনির্দিষ্ট দোয়া
  • সুরা ইখলাস, ফালাক ও নাস পড়া।
  • আয়াতুল কুরসি পড়া।
  • সুরা বাকারার শেষ দুই আয়াত পড়া।
  • সুরা মুলক পড়া।

ঘুম: আল্লাহর অশেষ নিয়ামত

ঘুম মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে এক অশেষ নিয়ামত। পবিত্র কোরআনের সুরা ফোরকানের ৪৭ নম্বর আয়াতে নিজেই বলেছেন, ‘আর তিনিই তোমাদের জন্য রাতকে করেছেন আবরণ, নিদ্রাকে করেছেন আরামপ্রদ আর দিনকে করেছেন (নিদ্রারূপী সাময়িক মৃত্যুর পর) আবার জীবন্ত হয়ে ওঠার সময়।’

অপরদিকে সুরা নাবার ৯-১০ নম্বর আয়াতে ঘুমকে প্রত্যেক জীবের জন্য প্রশান্তির মাধ্যম হিসেবে উল্লেখ করে আল্লাহ বলেছেন, ‘তোমাদের ঘুমকে শান্তির উপকরণ বানিয়েছি। আর রাতকে আবরণ করে দিয়েছি।’

নির্দিষ্ট কর্মসম্পাদনের পর প্রত্যেক সৃষ্টিই আল্লাহর দেওয়া ব্যবস্থাপনায় ঘুমিয়ে পড়ে। এ সময় তারা সম্পূর্ণরূপে অক্ষম ও অচেতন হয়ে যায়। অতঃপর ঘুম ক্লান্তি দূর করে পরবর্তী সময়ে নতুন করে পরিশ্রমের শক্তি জোগায়। ঘুম শেষে মানুষ যখন আবার জেগে ওঠে, তখন সে কোথায় ছিল, কী অবস্থায় ছিল—তার কিছুই বলতে পারে না।

ইতিহাসে আসহাবে কাহাফ বা গুহাবাসীর বর্ণনা পবিত্র কোরআনে এসেছে। তারা কয়েকশ বছর ঘুমিয়ে যখন জেগে ওঠে, তখন তাদের অনুভব হয়েছিল, তারা একদিনের কিছু বেশি সময় ঘুমিয়েছে। আবার কেউ বলে, তারা একবেলা ঘুমিয়েছে। অথচ তারা কয়েকশ বছর ঘুমিয়েছিল।

দোয়া কবুল হওয়ার শর্ত

  • হালাল, বৈধ ও পবিত্র জীবিকার ওপর নির্ভর হতে হবে।
  • হারাম উপার্জন (ফাঁকি, ধোঁকা, ওজনে কমবেশি, ভেজাল, খেয়ানত) ও হারাম খাদ্য থেকে বিরত থাকতে হবে।
  • দুনিয়াতে সবকিছুই শুধু আল্লাহর কাছে চাওয়া এবং বেশি করে চাওয়া।
  • সুখে-দুঃখে সর্বাবস্থায় আল্লাহর কাছে দোয়া করা।
  • আল্লাহর নাম ও ইসমে আজম দ্বারা দোয়া করা।
  • সৎকাজের আদেশ করা এবং অন্যায় কাজের নিষেধ করা।
  • দোয়ায় সর্বদা কল্যাণময় বিষয় কামনা করা।
  • মনোযোগ সহকারে দোয়া করা।
  • দোয়ার ফলাফলের জন্য ব্যস্ত না হওয়া।
  • দোয়া কবুল হওয়ার দৃঢ় আশা পোষণ করা।

যদি কোনো ব্যক্তি ইসলামের নির্দেশিত পদ্ধতিতে ঘুমায়, তার ঘুমও ইবাদতে পরিণত হয়। রাতে ঘুমানোর আগে কিছু করণীয়-বর্জনীয় কাজ রয়েছে।

রাতে ঘুমানোর সুন্নত ও করণীয়

রাতে দেরি করে না ঘুমানো

রাসুল (সা.) এশার নামাজের পর গল্পগুজব ও গভীর রাত পর্যন্ত সময় নষ্ট না করে তাড়াতাড়ি ঘুমানোর তাগিদ দিতেন। (মুসনাদে আবি ইয়ালা, হাদিস: ৪৮৭৯)

তাই রাতের বেলা কোনো অহেতুক কাজ, ইন্টারনেট ব্রাউজিং, কোনো বিনোদন উপভোগে সময় নষ্ট না করে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়া উচিত।

একাকি ঘরে না ঘুমানো

কোনো ঘরে একা ঘুমানোর ব্যাপারে হাদিসে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘রাসুল (সা.) কোনো ঘরে একাকি রাতযাপন ও একাকি সফর করতে নিষেধ করেছেন।’ (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস: ৫৬৫০)

খোলা আকাশের নিচে না ঘুমানো

অনুরূপ ছাদেও ঘুমানো যাবে না। নবী করিম (সা.) ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি বেষ্টনীবিহীন ছাদে রাতে ঘুমাল, (কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে) তার সম্পর্কে (আল্লাহর) কোনো জিম্মাদারি নেই।’ (আবু দাউদ, হাদিস: ৫০৪১)

রাতে নিরাপদে ঘুমানোর উপদেশ

রাতে নিরাপদে ঘুমানোর জন্য রাসুল (সা.) কিছু নির্দেশনা দিয়েছেন, যেগুলোর ওপর আমল করলে একদিকে বিপদ-আপদ থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে, অন্যদিকে প্রিয় নবীর সুন্নত আদায়ের সওয়াব পাওয়া যাবে।

  • জাবের (রা.) থেকে বর্ণিত, আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেন, ‘তোমরা রাতে পানাহারের পাত্রগুলো ঢেকে রেখো। ঘরের দরজাগুলো বন্ধ রেখো। আর সাঁঝের বেলা তোমাদের বাচ্চাদের ঘরে আটকে রেখো, কারণ এ সময় জিনেরা ছড়িয়ে পড়ে এবং কোনো কিছুকে দ্রুত পাকড়াও করে।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৩৩১৬)
  • খাবারের পাত্র ঢেকে রাখা।
  • ঘরের দরজা বন্ধ রাখা।
  • নিদ্রাকালে বাতি নিভিয়ে দেওয়া।

পবিত্রতা ও শুদ্ধতা

  • রাতে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও পবিত্র হয়ে শোয়া সুন্নত। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যদি কোনো মুসলমান রাতে আল্লাহকে স্মরণ করে অজু শেষে শয়ন করে এবং রাতে জাগ্রত হয়ে দুনিয়া ও আখিরাতের কোনো কল্যাণ আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে, আল্লাহ তাআলা তা দান করেন।’ (আবু দাউদ, হাদিস : ৫০৪২)
  • বিছানা ঝেড়ে নেওয়া। নবী করিম (সা.) বলেন, ‘যদি তোমাদের কেউ শয্যায় যায়, তখন সে যেন তার লুঙ্গির দ্বারা বিছানাটা ঝেড়ে নেয়।’ (বুখারি, হাদিস : ৬৩২০)

চোখে সুরমা লাগানো

ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, নবী (সা.)-এর একটি সুরমাদানি ছিল। প্রতি রাতে তিনি সুরমা লাগাতেন। (মুসনাদে আহমাদ)

এইভাবে মুসলিম জীবনে ঘুমের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। মহান আল্লাহর কাছে দোয়া করার মাধ্যমে তার রহমত লাভ করা, সুন্নতী কার্যাবলী অনুসরণ করা এবং সঠিক উপায়ে ঘুমানো মানব জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ।

ডান কাতে শোয়া

ডান কাতে শোয়ার মানে এই নয় যে সারা রাতই বাঁ দিকে কাত হওয়া যাবে না। তবে ইসলামে সব ভালো কাজে ডান দিকে প্রাধান্য দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। ঘুমানোর বেলায় ডান দিক থেকে শুরু করলে হৃৎপিণ্ড, পাকস্থলী এবং ফুসফুসের অবস্থান স্বাভাবিক থাকে। এটি বাঁ কাত হয়ে ঘুমানোর চেয়ে বেশি উপকারী।

দোয়া পড়া

রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি শোয়ার পর আল্লাহর নাম নেয় না, তার জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে লাঞ্ছনা নেমে আসবে।’ (আবু দাউদ, হাদিস : ৪৮৫৬)

ঘুমানোর আগে কিছু নির্দিষ্ট দোয়া পড়ার কথা হাদিসে উল্লেখ করা হয়েছে। যদি সব দোয়া পড়া সম্ভব না হয়, তবে এই ছোট দোয়াটি পড়তে পারেন: ‘আল্লাহুম্মা বিসমিকা আমুতু ওয়া আহ্ইয়া’। এর অর্থ: ‘হে আল্লাহ! তোমার নামে আমি শয়ন করছি এবং তোমার দয়ায় পুনরায় জাগ্রত হব।’

সুরা ইখলাস, ফালাক ও নাস পড়ে শরীরে ফুঁ দেওয়া

আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেন, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) প্রতি রাতে বিছানায় যাওয়ার সময় দুই হাত একত্র করে সুরা ইখলাস, সুরা ফালাক এবং সুরা নাস পড়ে তাতে ফুঁ দিতেন। এরপর মাথা ও মুখমণ্ডল থেকে শুরু করে যত দূর সম্ভব শরীরে তিনবার হাত বোলাতেন।’ (বুখারি, হাদিস : ৫০১৭)

আয়াতুল কুরসি পড়া

রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তুমি যখন শয্যা গ্রহণ করবে, তখন আয়াতুল কুরসি পড়বে। এতে আল্লাহর পক্ষ থেকে একজন রক্ষক তোমার জন্য সর্বদা নিযুক্ত থাকবে এবং শয়তান সকাল পর্যন্ত তোমার কাছে আসতে পারবে না।’ (বুখারি, হাদিস : ২৩১১)

সুরা বাকারার শেষ দুই আয়াত পড়া

রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘কোনো ব্যক্তি ঘুমানোর আগে সুরা বাকারার শেষ দুটি আয়াত পড়লে তা রাতভর তার নিরাপত্তার জন্য যথেষ্ট হবে।’ (বুখারি, হাদিস : ৫০৪০)

সুরা মুলক পড়া

রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘কোরআনে একটি সুরা আছে যার ৩০টি আয়াত রয়েছে। এটি কোনো ব্যক্তির পক্ষে সুপারিশ করলে তাকে ক্ষমা করা হয়। সুরাটি হলো তাবারাকাল্লাজি বিয়াদিহিল মুলক (সুরা মুলক)।’ (তিরমিজি, হাদিস : ২৮৯১)

রাসুল (সা.) সুরা মুলক না পড়ে কখনো ঘুমাতে যেতেন না। (তিরমিজি, হাদিস : ২৮৯২)

রাতে ঘুমানোর দোয়া সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নোত্তর

❓ ঘুমানোর আগে কোন দোয়া পড়া সুন্নত?

❓ ঘুম থেকে জাগার পরে কোন দোয়া পড়া উচিত?

❓ রাতে ঘুমানোর সুন্নতগুলো কী কী?

উপসংহারঃ

ইসলামে ঘুমের বিশেষ পদ্ধতি এবং দোয়াগুলো আমাদের দৈনন্দিন জীবনে শান্তি ও সাফল্য বয়ে আনে। এই নিয়মগুলো মেনে চললে আপনি শুধু ভালো ঘুম পাবেন না, বরং আল্লাহর রহমতও লাভ করবেন। আশা করি, এই পোস্ট থেকে আপনি উপকৃত হয়েছেন।

আপনারা আরও আকর্ষণীয় এবং শিক্ষণীয় ব্লগ পড়তে চাইলে ভিজিট করুন আমাদের সাইট StudyTika.com-এ। আমাদের আরও অনেক পোষ্ট আপনার জন্য অপেক্ষা করছে!

Getting Info...

إرسال تعليق

Oops!
It seems there is something wrong with your internet connection. Please connect to the internet and start browsing again.