আমাদের জীবনে চরিত্রের গুরুত্ব অপরিসীম। চরিত্র একটি শক্তি যা আমাদের আচরণ, মূল্যবোধ এবং নৈতিকতার প্রতিনিধিত্ব করে। চরিত্রে নিহিত আছে মানুষের পরিচয় ও মহত্ত্ব।
আজকের রচনায় আমরা চরিত্রের গঠন, এর গুরুত্ব এবং এর বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করব। আশা করি, এই রচনা পড়ে আপনি চরিত্রের সঠিক মূল্যায়ন করতে পারবেন।
চরিত্র রচনা ১
ভূমিকা : চরিত্র এমন একটি শক্তি, ব্যক্তিত্বের এমন একটি দিক যা ন্যায় নীতি ও নৈতিক জীবনাচরণের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত। একজন মানুষের স্বভাবে ভালো-মন্দ দুটো দিকই থাকতে পারে। মন্দের পাল্লা ভারি হলে সে দুশ্চরিত্র বলেই পরিচিত হয়। অন্যদিকে সৎ চরিত্রের অধিকারী বলতে আমরা বুঝি তিনি ন্যায়বান ও সুবিবেচক। অন্তর শক্তির দৃঢ়তা, অধ্যাবসায় ইত্যাদিও সুচরিত্রের অঙ্গ। চরিত্র অনুযায়ী গঠিত হয় ব্যক্তিজীবন যার প্রভাব গড়ে পরিবেশ ও সমাজ জীবনের ওপর।
চরিত্র কী: চরিত্র শব্দটি ইংরেজি 'Character'-এর সমার্থক হলেও এর মূল এসেছে গ্রিক ভাষা থেকে। প্রাথমিকভাবে এটি 'চিহ্ন' অর্থে ব্যবহৃত হতো, তবে প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে থেকে এটি মানুষের আচরণ ও আদর্শের উৎকৃষ্ট গুণ বোঝাতে ব্যবহৃত হচ্ছে। চরিত্র গঠনের দুটি দিক রয়েছে: সচ্চরিত্র ও দুশ্চরিত্র। উৎকৃষ্ট গুণাবলীর সমন্বয়ে গঠিত চরিত্রকে বলা হয় সচ্চরিত্র, আর যদি চরিত্রের প্রধান বৈশিষ্ট্য হয় মানুষের ভেতরে থাকা পশুত্ব বা নীচতা, তাহলে তা দুশ্চরিত্র। চরিত্র মানবজীবনের এক অমূল্য ও অবিনাশী সম্পদ। সৎ চরিত্রের অধিকারী ব্যক্তি সমাজের শ্রেষ্ঠ অলংকার, যার নৈতিক দৃঢ়তা যেন এক প্রজ্বলিত দীপশিখা। এজন্যই চরিত্রকে জীবনের মুকুট বলা হয়। সততা, সহানুভূতি, সংবেদনশীলতা, ন্যায়পরায়ণতা, ক্ষমা, ঔদার্য এবং আত্মসংযম হলো সচ্চরিত্রের লক্ষণ।
চরিত্র গঠনের গুরুত্ব : চরিত্রের গুরুত্ব এতটাই যে তা ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন। একজন মানুষের জীবনে বিদ্যার মূল্য অপরিসীম, কিন্তু চরিত্রের মূল্য আরও বেশি। প্রাচীন প্রবাদ বলে, ‘দুর্জন বিদ্যান হলেও পরিত্যাজ্য’, অর্থাৎ জ্ঞান থাকা সত্ত্বেও একজন খারাপ চরিত্রের মানুষ সমাজে অকল্যাণকর। আবার একে বলা হয়, ‘অমরত্বের সুধা পান না করেও মানুষ অমর হতে পারে কেবল চরিত্রের গুণে।’ তাই ব্যক্তির প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত চরিত্রের বিকাশ সাধন করা, কারণ চরিত্র মানুষের ভাগ্যও নির্ধারণ করে।
চরিত্র গঠনমূলক শিক্ষার লক্ষ্য : চরিত্র গঠনের ক্ষেত্রে শিক্ষার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। যুক্তির শক্তির মাধ্যমে সমাজস্বীকৃত আচরণ অনুসরণে ব্যক্তির ইচ্ছা ও সামর্থ্যকে বিকশিত করা শিক্ষার একটি লক্ষ্য। শিক্ষার মাধ্যমে ন্যায়পরায়ণতা, সততা, শৃঙ্খলা, সৌজন্য এবং মানবিক গুণাবলির বিকাশ ঘটে। চরিত্র গঠনমূলক শিক্ষার ক্ষেত্রে বিশেষত ধৈর্য, সাহস, শৃঙ্খলা, ন্যায়বিচার, মানবপ্রেম ইত্যাদি গুণাবলির উপর গুরুত্ব দিতে হয়।
শিক্ষার মাধ্যমে চরিত্র গঠনের পদ্ধতি : চরিত্র গঠনমূলক শিক্ষার দুটি পদ্ধতি রয়েছে: প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ। প্রত্যক্ষ পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীদের ন্যায়নীতি, সৌজন্য, কৃতজ্ঞতা ইত্যাদি গুণাবলির প্রতি আগ্রহ তৈরি করা হয়। পরোক্ষ পদ্ধতিতে, ইতিহাস, সাহিত্য এবং জীবনের পাঠ থেকে শিক্ষার্থীদের মধ্যে মূল্যবোধ ও দৈনন্দিন আচরণ বিকাশ করা হয়। এভাবে মহৎ চরিত্র সম্পর্কে ধারণা তৈরির মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা আদর্শ মানুষ হতে পারে।
শিশু বয়সে চরিত্র গঠন : শিশুর চরিত্র গঠন করার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করা এবং তাদের সৎ সঙ্গী নির্বাচনে অভিভাবকদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। শিশুর সৃজনশীলতা ও মানবিক গুণাবলির বিকাশ ঘটাতে হলে সৎ সঙ্গ অপরিহার্য। বিদ্যালয় জীবন এবং শিক্ষকদের প্রভাবও শিশুর চরিত্র বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ। টেলিভিশন ও গণমাধ্যমের প্রভাব থেকেও শিশুদের সুরক্ষা করতে হবে যাতে তারা অনুপযুক্ত বিষয়বস্তুর কুপ্রভাব থেকে সুরক্ষিত থাকে।
চরিত্র গঠনের সাধনা : চরিত্র গঠনের জন্য ব্যক্তির নিজস্ব সাধনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। লোভ, লালসা এবং অসৎ প্রবৃত্তি থেকে নিজেকে দূরে রাখা এবং সত্যের পথে অবিচল থাকা ব্যক্তির সুচরিত্র বিকাশে সহায়ক। "যে ব্যক্তি চরিত্র হারায়, সে সবকিছু হারায়" – এই প্রবাদটি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, চরিত্র একবার হারালে তা আর ফিরে পাওয়া যায় না। তাই ব্যক্তিকে আমৃত্যু তার চরিত্র রক্ষার জন্য সংগ্রাম করতে হবে।
মহৎ চরিত্রের দৃষ্টান্ত : মহৎ চরিত্রের অধিকারী ব্যক্তিরা ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে রয়েছেন। মহানবী হযরত মুহাম্মদ (স.), মহাত্মা গান্ধী, বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ প্রমুখ চরিত্র শক্তির উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তাদের ন্যায়পরায়ণতা এবং সমাজসেবার জন্য তারা আজও শ্রদ্ধার সাথে স্মরণীয়। মহৎ চরিত্রের অধিকারীরা সমাজে সবার জন্য আদর্শ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন।
উপসংহার : আজকের পৃথিবীতে মূল্যবোধের অবক্ষয় দেখা যাচ্ছে। মানুষ তার নৈতিক শক্তি হারিয়ে ফেলছে, অনৈতিক জীবনের দিকে ধাবিত হচ্ছে। কিন্তু চরিত্রই মানুষের শ্রেষ্ঠ সম্পদ, যা তাকে পৃথিবীতে চিরস্মরণীয় করে রাখে। তাই চরিত্র গঠন ও রক্ষা করার সাধনাই হওয়া উচিত জীবনের প্রধান লক্ষ্য।
[ একই রচনা আরেকটি বই থেকে সংগ্রহ করে দেয়া হলো ]
চরিত্র রচনা ২
ভূমিকা : কোনো ব্যক্তির আচরণ ও আদর্শের উৎকর্ষতাবাচক গুণ বোঝাতে চরিত্র শব্দটি ব্যবহৃত হয়। ‘চরিত্র’ বলতে আমরা বুঝি কথাবার্তায়, কাজ-কর্মে এবং চিন্তা-ভাবনায় একটি পবিত্র ভাব। মানুষকে তা ন্যায়পথে, সৎপথে পরিচালিত করে। মানুষের সর্বোৎকৃষ্ট গুণাবলির মধ্যে চরিত্র অন্যতম। এর মধ্যে মানুষের পরিচয় নিহিত। চরিত্রই মনুষ্যত্বের পরিচায়ক। তাই বিখ্যাত ইংরেজ লেখক সেমুয়্যাল স্মাইলস তাঁর ‘Character’ প্রবন্ধে বলেছেন- "The crown and glory of life is character."
চরিত্রের উপাদান বা বৈশিষ্ট্য : সততা, সত্যনিষ্ঠা, প্রেম, পরোপকারিতা, দায়িত্ববোধ, শৃঙ্খলা, অধ্যবসায় ও কর্তব্যপালন হল চরিত্রের মৌলিক উপাদান। এগুলো মানুষ যখন সহজে নিজর মধ্যে বিকশিত করে তোলে এবং স্বতঃস্ফূর্তভাবে তার প্রতিটি কথা ও কাজের মাধ্যমে তা ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম হয়, তখন উত্তমচরিত্র তার স্বভাবের সাথে সমীভূত হয়ে যায়। ফলে, দৈনন্দিন জীবনের স্বাভাবিক আচরণেও উত্তমচরিত্রের বৈশিষ্ট্যাবলি প্রকাশ পেতে থাকে। আর এ-পর্যায়ে গিয়ে ব্যক্তি তার চরিত্রকে একটি সম্পদ হিসেবে আবিষ্কার করে।
১. মানবিক গুণাবলির সমাহার : ধৈর্য, সাহস, আনুগত্য, সততা, সৌজন্য, নির্ভরযোগ্যতা, কৃতজ্ঞতাবোধ, সহজ অমায়িকতা, পরিহিতব্রত ইত্যাদি গুণাবলি।
২. শৃঙ্খলা, সময়ানুবর্তিতা : শৃঙ্খলা, সময়ানুবর্তিতা, সহিষ্ণুতা, শিষ্টাচার ইত্যাদি সামগ্রিক আচার-আচরণ-অভ্যাস।
৩. দেশপ্রেম, জাতীয়তাবোধ : দেশপ্রেম, অসাম্প্রদায়িকতা, জাতীয়তাবোধ, আন্তর্জাতিক সৌভ্রাতৃত্ব, মানবপ্রেম ইত্যাদি সংগঠিত ভাবাবেগ।
৪. মানসিকতা ও বদ অভ্যাস দমন : হিংসা, বিদ্বেষ, কুটিলতা, ইত্যাদি মানসিকতা পরিহার এবং বদ অভ্যাস বা প্রবৃত্তি দমন।
৫. মানবিক গুণাবলির গ্রহণ : ন্যায়বিচার, মানবকল্যাণ, পরহিতব্রত ইত্যাদি মানবিক গুণাবলিকে জীবনের চালিকাশক্তি হিসেবে গ্রহণ।
সচ্চরিত্রের বৈশিষ্ট্য: সঠিক নৈতিকতা বা শুধু ন্যায়নিষ্ঠা দিয়ে চরিত্র গঠিত হয় না। প্রকৃত চরিত্রে মানুষের সকল মানবিক গুণাবলি ও আদর্শের সমন্বয় থাকতে হবে। একজন চরিত্রবান ব্যক্তি জাগতিক লোভ-লালসার বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে সত্য ও ন্যায়ের পথে দৃঢ় থাকেন। তিনি কখনো সত্য থেকে বিচ্যুত হন না, অন্যায়কে প্রশ্রয় দেন না, রাগ বা আনন্দে নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারান না, অহংকার করেন না, এবং অন্যের প্রতি নিষ্ঠুর আচরণ করেন না।
সচ্চরিত্রের ফল : চরিত্রের মাধ্যমেই ঘোষিত হয় জীবনের গৌরব। চরিত্র দিয়ে জীবনের যে গৌরবময় বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পায় তা আর কিছুতেই সম্ভব নয় বলে সবার উপরে চরিত্রের সুমহান মর্যাদা স্বীকৃত। যার পরশে জীবন ঐশ্বর্যমণ্ডিত হয় এবং যার বদৌলতে মানুষ জনসমাজে শ্রদ্ধা ও সম্মানের পাত্র হিসেবে আদৃত হয়ে থাকে, তার মূলে রয়েছে উত্তম চরিত্র।
চরিত্র গঠনের সময় ও উপায় : চরিত্র গঠনের কাজ শিশুকাল থেকে মরণের পূর্ব পর্যন্ত চলতে থাকে। তাই চরিত্রের ওপর পরিবার, সমাজ ও পারিপার্শ্বিক সামাজিক বিধি-ব্যবস্থা প্রভাব বিস্তার করে।
চরিত্র গঠনে পরিবারের ভূমিকা : শিশুকাল ও শৈশবকালই হচ্ছে চরিত্র গঠনের উৎকৃষ্ট সময়। তাই বাসগৃহকে চরিত্র গঠনের উপযুক্ত স্থান হিসেবে বিবেচনা করা হয়। শিশুকে সৃষ্টিশীল কাজে উৎসাহিত করা হলে তাতে সৃজনী প্রতিভা বিকশিত হয়। প্রত্যেক শিশুই নিষ্পাপ হয়ে জন্মগ্রহণ করে। শিশুরা স্বভাবতই অনুকরণপ্রিয়।
চরিত্র গঠনে সামাজিক প্রভাব: শিশুর চরিত্র গঠনে মাতা-পিতা, আত্মীয়-স্বজন এবং পাড়া-প্রতিবেশীর পরিবেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। শিক্ষাজীবনে বিদ্যালয়ে, বন্ধুদের সাথে খেলাধুলা ও সঙ্গের প্রভাবেও তাদের আসল চরিত্র গড়ে ওঠে। সমাজের এসব প্রভাবই ধীরে ধীরে শিশুর ব্যক্তিত্ব ও নৈতিকতার ভিত্তি স্থাপন করে।
চরিত্র গঠনে পারিপার্শ্বিক অবস্থার প্রভাব : মানবচরিত্র গঠনে পারিপার্শ্বের গুরুত্ব অপরিসীম। সে যেরূপ পারিপার্শ্বিক অবস্থার মধ্যে বাস করে, সাধারণত তার চরিত্র সেভাবেই গঠিত হয়।
চরিত্র গঠনে স্বীয় সাধনা : চরিত্রলাভের প্রধান উপায় স্বীয়-সাধনা। চরিত্র সাধনার ধন। বহুদিনের সাধনার বলে তা অর্জন ও রক্ষা করতে হয়।
চরিত্র গঠনে মহামানবদের উদাহরণ : পৃথিবীতে আজ যাঁরা স্বীয় কর্মবলে চিরস্মরণীয় হয়ে রয়েছেন বা সমাজের মনুষ্য মহাকল্যাণ সাধন করে গিয়েছেন, তাঁদের জীবন-কাহিনী পড়লে দেখতে পাওয়া যায়, তাঁরা সকলেই ছিলেন চরিত্রবান এবং আদর্শ মহাপুরুষ।
চরিত্রহীন ব্যক্তি ঘৃণার পাত্র : মানবের সম্পদ একমাত্র চরিত্র। চরিত্রহীন লোক পশুর চেয়েও অধম। স্বাস্থ্য, অর্থ এবং বিদ্যাকে আমরা মানবজীবনের অপরিহার্য উপাদান হিসেবে বিবেচনা করি। কিন্তু জীবনক্ষেত্রে এগুলোর যতই অবদান থাক না কেন, এককভাবে এগুলোর কোনোটিই মানুষকে সর্বোত্তম মানুষে পরিণত করতে সক্ষম নয়, যদি না সে সচ্চরিত্রবান না হয়।
উপসংহার : চরিত্রের কাছে পার্থিব সম্পদ ও বিত্ত অতি নগণ্য। প্রাচুর্যের বিনিময়ে চরিত্রকে কেনা যায় না। মানবজীবনে চরিত্রের মতো বড় অলঙ্কার আর নেই।
চরিত্রের গুরুত্ব বুঝতে পারা এবং তাকে রক্ষা করা আমাদের জীবনের প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত। চরিত্র আমাদের শ্রেষ্ঠ সম্পদ, যা আমাদের অনন্য করে তোলে। তাই আমি আপনাদের আমন্ত্রণ জানাচ্ছি আমার ওয়েবসাইটে আরও রচনা পড়ার জন্য।
এখানে অনেক শিক্ষণীয় বিষয়বস্তু রয়েছে যা আপনার জ্ঞানের ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করবে।
↬ জীবনগঠন ও চরিত্র ↬ চরিত্র ও মানব-জীবন ↬ চরিত্রই সম্পদ ↬ সৎ চরিত্র