বিশ্বের শীর্ষ সম্মাননার মধ্যে একটি হলো নোবেল পুরস্কার। আজকের এই রচনায় আমরা আলোচনা করেছি নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস সম্পর্কে। তাঁর অবদান এবং সংগ্রাম আমাদের সকলের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস। পড়ুন পুরো রচনা, যেখানে বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হয়েছে তাঁর জীবন ও কর্ম।
নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস রচনা ১
ভূমিকা
আজ পর্যন্ত যে তিনজন বাঙালি সম্মানজনক নোবেল পুরস্কার লাভ করেছেন ড.মোহাম্মদ ইউনুস তাদের মধ্যে অন্যতম। একজন অর্থনীতিবিদ হয়েও শান্তিতে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন ডা. মোহাম্মদ ইউনুস। প্রথম বাংলাদেশী হিসেবে তার এই প্রাপ্তি আমাদের জাতীয় জীবনের একটি বড় পাওয়া। ডা. মোঃ ইউনুস আজ বাংলাদেশের ভাবমূর্তি শুধু উজ্জ্বল করেননি বরং দেশটিকে বিশ্ব মানচিত্রে ব্যাপক পরিচিত দান করেছেন। দারিদ্র্যের অভিশাপ থেকে মানুষের মুক্তির জন্য তার আবিষ্কৃত "ক্ষুদ্র ঋণ প্রকল্প" বিশ্বের বিভিন্ন দেশের জন্য উত্তম মডেল ও আদর্শের উৎস হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে।
ড. মোহাম্মদ ইউনুসের পরিচয়
'Banker or the poor' খ্যাত দুস্ত ও অসহায় মানুষের দিশারী, সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন পুরুষ, বাংলার গৌরব, নোবেল বিজয়ী ড. মোহাম্মদ ইউনুসের জন্ম চট্টগ্রাম জেলা হাটহাজারী থানার অন্তর্গত বধুয়া গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে। তার পিতা ছিলেন হাজী দুলা মিয়া সওদাগর, মাতা সুফিয়া খাতুন। ১৪ ভাই বোনের মধ্যে ডঃ মুহাম্মদ ইউনুস ছিলেন তৃতীয়। শৈশবে তার পাঁচজন ভাই বোন মারা যায়। তার পিতা ছিলেন স্বর্ণ ব্যবসায়ী। তিনি সবসময় সন্তানদের উচ্চশিক্ষা লাভের উৎসাহিত করতেন। তার মা সুফিয়া খাতুন দুঃখ অসহায় মানুষদের অকাতরে সাহায্য করতেন।
ড. মোহাম্মদ ইউনুসের ছাত্রজীবন
ইউনুস ছাত্র জীবনে অসাধারণ মেধার অধিকারী ছিলেন। তিনি চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল থেকে মেধা তালিকায় ১৬তম স্থান নিয়ে এসএসসি পাস করেন এবং ১৯৫৭ সালে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৬১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি অর্থনীতিতে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। ইউনুস ১৯৬৫ সালে তেনেসির নাস বিলে অবস্থিত ভেন্ডার বিল্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি ডিগ্রি করার জন্য ফুলব্রাইট ফেলোশীপ পান।
ড. মোহাম্মদ ইউনুসের কর্মজীবন
১৯৬১ সালে ইউনুস চট্টগ্রাম কলেজে অর্থনীতি বিভাগের লেকচারার হিসেবে যোগ দেন। এরপর উচ্চতর ডিগ্রীর জন্য বিদেশে চলে যান। পিএইডি লাভের পর তিনি ১৯৬৯ সাল থেকে মিডল টেনেসি টেস্ট ইউনিভার্সিটিতে অর্থনীতি সহকারি অধ্যাপক হিসেবে নিযুক্ত হন। ডাঃ ইউনূস ১৯৭২ সালে দেশে ফিরে এসে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগের প্রধান নিযুক্ত হন।
ড. মোহাম্মদ ইউনুস কেন এবং কিভাবে দারিদ্র লাঘবে মনোনিবেশ করেন
সদ্য স্বাধীনতা প্রাপ্ত বাংলাদেশের আর্থসামাজিক অবস্থা যে ক্রমশ খারাপের দিকে যাচ্ছে তা অধ্যাপক ইউনূসের দৃষ্টিগোচর হয়। বিশেষ করে বাংলাদেশের ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ তার জীবন ধারাকে সম্পূর্ণ পাল্টে দেয়। তার মনে এ ভাবনার উদ্যোগ হয় যে, লোকজন অর্ধাহারে অনাহারে রাস্তাঘাটে ধুঁকে ধুঁকে মরছে অথচ তিনি অর্থনীতির অভিজাত মতবাদ শিক্ষা দিচ্ছেন। তিনি অর্থনীতির অভিজাত মতবাদের অসারতা ও অসম্পূর্ণতা অনুধাবন করেন এবং গরিব জনগোষ্ঠীর ভাগ্য উন্নয়নকে তার মহান ত্যাগ হিসেবে বেছে নেন। তিনি তাদের জীবন জীবিকা সম্পর্কে অনুসন্ধান করতে থাকেন এবং তাদের নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। বাশের টুর বা চৌকি তৈরি করেছিলেন এমন একজন মহিলার সাথে তিনি যখন একদিন কথা বলছিলেন, তখন তিনি জানতে পারেন যে মহিলাটির নিজের কোন মূলধন না থাকায় তারা এর ৯৩% এর বেশি মধ্য স্বত্বভোগীকে দিয়ে দিতে হয়। ডাঃ ইউনুস তাদের দারিদ্র্য নেপথ্যে এ প্রধান সমস্যাটি চিহ্নহিত করেন। তিনি বুঝতে পারেন যে, লোকজন আজ এত গরিব থাকার কারণ হচ্ছে তাদেরকে অর্থনৈতিক সহযোগিতা করার কোন প্রতিষ্ঠান না থাকা। এজন্য তিনি দেশকে দারিদ্র্যমুক্ত করার দিকে মননিবেশ করেন এবং এভাবেই তার মনে ক্ষুদ্র ঋণ ধারণার উন্মেষ ঘটে।
গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা ড. মোহাম্মদ ইউনুস
১৯৭৪ সালের সর্বপ্রথম তার মনে গ্রামীণ ব্যাংকের ধারণা জন্ম হয়। ১৯৭৬ সালে তিনি তার ধারণাকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার ব্রতী হন। এজন্য তিনি আপাত দৃষ্টিতে সনাতন ব্যাংক ঋণ পাওয়ার ও যোগ্য গরিব লোকদের ক্ষুদ্রঋণ দেওয়ার জন্য জোবরা গ্রামে গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। ১৯৮৩ সালে তিনি একটি বিশেষায়িত ব্যাংক হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছ থেকে গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা অনুষ্ঠানিক অনুমোদন পান। ১৯৯৭ সালে তিনি ওয়াশিংটন ডিসিতে ক্ষুদ্রঋণ শীর্ষক বৈঠক করেন। এভাবে তার গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা লাভ করে।
গ্রামীণ ব্যাংকের কার্যক্রম
গ্রামীণ ব্যাংকের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে দারিদ্র দূর করা। তাই দরিদ্র লোকদের স্বাবলম্বী হতে এই ব্যাংক ঋণ দিয়ে সহায়তা করে। এর দুই মিলিয়নেরও বেশি ঋণ গ্রহীতা রয়েছে। বাংলাদেশের ৮৫ হাজার গ্রামের মধ্যে ৩৫ হাজার গ্রামে এ ব্যাংক তার কার্যক্রম পরিচালনা করেছে। গ্রামীণ ব্যাংকের ঋণগ্রহীতার মধ্যে ৯৪% এ মহিলা। এটি জামানত বিহীন ঋণ দিয়ে থাকে। এই ঋণের ৯৮% পর্যায়ক্রমে পরিশোধ করতে হয়। বর্তমানে গ্রামীণ ব্যাংক বিশ্বের সর্ববৃহৎ ক্ষুদ্র ঋণদানকারী প্রতিষ্ঠান।
ড. মোহাম্মদ ইউনুসের দর্শন
ডা: মোহাম্মদ ইউনূসের দর্শনের মূলে রয়েছে মানব প্রেম। এ দর্শনে উদ্বুদ্ধ হয়েই তিনি মানব জাতিকে দারিদ্র্যের রূঢ় বাস্তবতা থেকে মুক্তির পথ দেখাতে চেয়েছেন। তিনি মনে করেন যে, দারিদ্র্যের অভিশাপটিকে মুক্তি পাওয়ার জন্য গরিবদের মধ্যে সবচেয়ে গরিব যারা তারাই গ্রহণযোগ্য ঋণ পাওয়ার সবচেয়ে বেশি উপযোগী। এটি তার দর্শনের মূলতত্ত্ব। তার দর্শন পুঁজিবাদকে ধ্বংস করে সমাজের সামনের সুফল বয়ে আনার পক্ষপাতি।
ড. মোহাম্মদ ইউনুসকে নোবেল শান্তি পুরস্কারে ভূষিত করা হয় কেন?
অধ্যাপক ইউনুস এবং তার গ্রামীণ ব্যাংক ২০০৬ সালে ১৩ই অক্টোবর শুক্রবারে নোবেল শান্তি পুরস্কারের ঘোষিত হয়। ক্ষুদ্রঋণের জগতে তার অসাধারণ নবরীতির জন্য তাকে এ পুরস্কারে ভূষিত করা হয়, যা লক্ষ লক্ষ লোককে দারিদ্র্যের কারাগার থেকে মুক্তির পথ দেখিয়েছে। ডাঃ ইউনুস ও তার গ্রামীণ ব্যাংক দেখিয়েছে যে, ঋণ সহায়তা পেলে সবচেয়ে দরিদ্র দুস্থ লোক ও নিজেদের ভাগ্যের উন্নয়ন করতে পারে। তবে উপার্জন মুখী কর্মকান্ডে পুরুষের সাথে নারীরাও যদি সমানভাবে অংশগ্রহণ না করে তাহলে দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং গণতন্ত্র তার লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হবে। এজন্য গ্রামীণ ব্যাংক নারীদের স্বাবলম্বী হওয়ার বিষয়টিকে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ প্রদান করে। ২০০৬ সালে ১০ ডিসেম্বর এক ঝাকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে নরওয়ের রাজধানী অসলোতে অধ্যাপক ইউনুস এবং গ্রামীন ব্যাংকের পক্ষ থেকে নূরজাহান নোবেল পুরস্কার হিসেবে ১০ মিলিয়ন ক্রোনাস অর্থ, একটি স্বর্ণপদক এবং একটি সনদপত্র গ্রহণ করেন।
নোবেল শান্তি পুরস্কারে ভূষিত হওয়ায় তার অনুভূতি কি?
গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনুস জানতে পেরে অভিভূত হন যে, তিনি ও তাঁর প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যাংক নোবেল শান্তি পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। প্রথমে তিনি বিষয়টি বিশ্বাসই করতে পারেননি। সত্যতা নিশ্চিত করার জন্য তিনি নোবেল কমিটিতে ফোন করে খবরটি যাচাই করেন। পরে যখন নিশ্চিত হন, তখন তিনি খুব অবাক হন। এই খবরে শুধু তিনি নয়, পুরো দেশবাসীও বিস্মিত ও আনন্দিত হয়।
ড.ইউনুস তার ক্ষুদ্রঋণ প্রথম কিভাবে প্রয়োগ করেন?
তিনি তার ছাত্রদের নিয়ে জোবরা গ্রামে প্রথম জরিপ চালান এবং ৪২ জন মহিলাকে নির্বাচন করে ৮৫৫ টাকা দিন দেন। এ টাকা তিনি আর ফেরত নেননি। তিনি আরও ২৭ ডলার ঋণ দিয়ে তাদেরকে স্বাবলম্বী হতে অনুপ্রাণিত করেন এবং আর্থিক সচ্ছলতা ফিরে এলে এ টাকা যখন ইচ্ছে ফেরত দেওয়ার কথা বলে। তারা এক বছরের মধ্যে সে টাকা তাকে ফেরত দিলেন এবং এই উদ্দীপনা থেকে তিনি গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠায় উদ্বুদ্ধ হন।
ক্ষুদ্রঋণের অবস্থান
বস্তুত ডঃ ইউনূসের সবচেয়ে জনপ্রিয় দারিদ্র্যমুক্তির পন্থা হিসেবে পরিগণিতা হয়েছে। মাইকো ক্রেডিট সামিট এর সূত্র অনুসারে গত বছর ১৩০ টি দেশে ৩ হাজারও বেশি প্রতিষ্ঠান থেকে ১০০ মিলিয়নেরও বেশি লোক ক্ষুদ্র ঋণ নিয়েছিল। জনপ্রতি গড়ে গ্রামীণ ব্যাংকের ঋণ ছিল ১৩০ ডলার।
ডাঃ ইউনুস এর কর্মপরিধি
১৯৯৩ থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত ইউএন সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক ইউনুসকে আন্তর্জাতিক উপদেষ্টা হিসেবে অনুষ্ঠিত মহিলা বিষয়ক চতুর্থ বিশ্ব সম্মেলনে নিয়োগ দেন। অধ্যাপক ইউনুস মহিলা স্বাস্থ্য বিষয়ক গ্লোবাল কমিশন, অব্যাহত অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য উপদেষ্টা কাউন্সিল এবং মহিলা ও অর্থনীতি বিষয়ক ইউএন বিশেষজ্ঞ দলেও কাজ করেন। তিনি কন্সালটেটিভ গ্রুপ টু এসিস্ট দ্যা পোরেস্ট এর পলিসি এডভাইজারি গ্রুপ এর মুখ্য দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়া শিক্ষা ,জনসংখ্যা, স্বাস্থ্য, দুর্যোগ প্রতিরোধ, ব্যাংকিং এবং বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডের কমিশন ও কমিটিতে তিনি কাজ করেন। বর্তমানে তিনি বহু আন্তর্জাতিক সংস্থা যেমন-আমানা ইখতিয়ার মালয়েশিয়া ফিলিপাইনে আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা কেন্দ্র এবং মালয়েশিয়ার দরিদ্র তাহবিলে কাজ করেছেন। অধ্যাপক ইউনুস "কালবাট ওয়ার্ল্ড" "ভ্যালু ফাউন্ড", আন্তর্জাতিক জাতি বিষয়ক সহযোগিতার সংস্থা, "ক্ষুদা নিবৃত্তি জাতীয় কাউন্সিল", রেজাল্ট এবং আশুকা ফাউন্ডেশন এর আন্তর্জাতিক কাউন্সিল ভূমিকা রাখেন।
অধ্যাপক ইউনূস এর প্রাপ্ত পুরস্কার সমূহ
অধ্যাপক ইউনুস তাঁর অসাধারণ সাফল্যের স্বীকৃতি হিসেবে দেশ-বিদেশে বহু সম্মাননা ও পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। আন্তর্জাতিকভাবে তিনি পেয়েছেন—১৯৮৪ সালে ম্যানিলা থেকে "রেমন ম্যাগসেসে পুরস্কার", ১৯৮৯ সালে জেনেভা থেকে আর্কিটেকচারের জন্য "আখাগার পুরস্কার", ১৯৯৩ সালে শ্রীলঙ্কা থেকে বিজ্ঞানে অবদানের জন্য "মোঃ শাহাব উদ্দিন পুরস্কার", ১৯৯৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ব খাদ্য ফাউন্ডেশন প্রদত্ত "বিশ্ব খাদ্য পুরস্কার" এবং ২০০৬ সালে "সিউল শান্তি পুরস্কার"। দেশের পক্ষ থেকে তিনি পেয়েছেন—১৯৭৮ সালে "রাষ্ট্রপতি পুরস্কার", ১৯৮৫ সালে "কেন্দ্রীয় ব্যাংক পুরস্কার", এবং ১৯৮৭ সালে "স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার"। এছাড়াও, ২০০৬ সালে ভারতের জনপ্রিয় টিভি চ্যানেল ইটিভি বাংলার পক্ষ থেকে তিনি "জীবিত শ্রেষ্ঠ বাঙালি" সম্মাননা লাভ করেন।
উপসংহার
ডঃ ইউনুস তার গ্রামীণ ব্যাংকের মাধ্যমে আমাদের জন্য গৌরব বয়ে এনেছেন। তার ক্ষুদ্র ঋণ বিশ্বকে দারিদ্র্যমুক্তির একটি কার্যকারী পথ দেখিয়েছে। তিনি আমাদের জন্য বয়ে এনেছেন নোবেল পুরস্কার। শুধু তাই নয়, তিনি বিশ্বের জন্য একজন অনুকরণীয় আদর্শ এবং তার ক্ষুদ্র ঋণ বিশ্ববাসীর জন্য স্বাবলম্বী হওয়ার একটি অদ্বিতীয় পন্থা। তার ক্ষুদ্র ঋণ দারিদ্র্যকে জাদুঘরে বন্দী করতে সক্ষম। অতীতে আমাদের জন্য তার মত এত বড় সম্মান আর কেউ বয়ে আনতে সক্ষম হননি। তাই "ড.ইউনুস আমাদের গৌরব"।
নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস রচনা ২
ভূমিকা :
‘যখনি চিত্ত জেগেছে / শুনেছ বাণী
তখনি এসেছে প্রভাত / যাও তোমার ব্রতপালনে’
-রবীন্দ্রনাথ
এই মহাব্রত উদ্যাপনে যাঁরা নিজেদের উৎসর্গ করেছেন, মানবতার বেদীমূলে যাঁদের জীবন অর্ঘ্য-রূপে নিত্য নিবেদিত, যাঁরা ক্ষুধাক্লিষ্ট, আর্ত, দারিদ্র্য-জর্জর, অসহায় মানুষের আশ্রয়, তাপিত-প্রাণে শান্তির শীতল বারি, সন্তাপে সান্ত্বনা, রুক্ষ ধূসর প্রেমহীন মরু-জীবনে যাঁরা করুণা-উৎস, তাঁদের মধ্যে ড. মুহাম্মদ ইউনূস-এর নামও স্বরণীয়। পৃথিবী থেকে ক্ষুধা, দারিদ্র্য, অভাবের চিরবিদায়ী কাণ্ডারী, সহস্রাব্দের তূর্যবাদক, শতাব্দীর বার্তাবহক ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
'Some are born great,
Some achieve greatness, and
some have greatness thrust
upon them.'
... William Shakespeare
জন্ম ও শিক্ষাজীবন :
ড. মুহাম্মদ ইউনূস এর জন্ম ১৯৪০ সালে, চট্টগ্রামের হাটহাজারীর বথুয়া গ্রামে। তাঁর পিতা হাজী দুলা মিয়া সওদাগর ও মাতা সুফিয়া খাতুন। তিনি ছিলেন ১৪ ভাইবোনের মধ্যে তৃতীয়। ভাইবোনদের পাঁচজনই মারা যায় শৈশবে। ১৯৪৭ সালে চলে আসেন চট্টগ্রাম শহরে। প্রথম পড়াশোনা গ্রামের স্কুলেই। এরপর লামাবাজার প্রাইমারি স্কুল, চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলে পড়েছেন। এখান থেকেই এস. এস. সি. পাস করেন মেধা তালিকায় ১৬তম স্থান নিয়ে। স্কুল জীবনে স্কাউট ছিলেন। ১৯৫৫ সালে কানাডার ওয়ার্ল্ড স্কাউট জাম্বোরিতে অংশগ্রহণ করেন। চট্টগ্রাম কলেজে পড়াশোনার সময় সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডেও অংশ নেন। নাটক অভিনয়ের জন্য পুরস্কৃত হন। ১৯৫৭ সালে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে। সেখান থেকেই ১৯৬০ সালে বি.এ. ও ১৯৬১ সালে নেন এম.এ. ডিগ্রি। গ্র্যাজুয়েশনের পর যোগ দেন অর্থনীতি ব্যুরোতে এবং গবেষণা সহকারি হিসেবে কাজ করেন প্রফেসর নুরুল ইসলাম ও রেহমান সোবহানের অধীনে।
কর্মজীবন :
১৯৬১ সালে ড. মুহাম্মদ ইউনুস চট্টগ্রাম কলেজে অর্থনীতি বিভাগের লেকচারার হিসেবে যোগ দেন। পরে তিনি উচ্চশিক্ষার জন্য আমেরিকায় যান এবং ১৯৬৯ সালে ভ্যান্ডারবিল্ট ইউনিভার্সিটি থেকে অর্থনীতিতে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর ১৯৬৯ থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত তিনি মিডল টেনেসি স্টেট ইউনিভার্সিটিতে অর্থনীতির অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর হিসেবে শিক্ষকতা করেন। দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে তিনি বাংলাদেশে ফিরে আসেন এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে প্রফেসর হিসেবে যোগ দেন। ১৯৭৪ সালে তিনি প্রথম ক্ষুদ্র ঋণ কার্যক্রম শুরু করেন এবং একই বছর ‘তেভাগা খামার’ ও ‘গ্রামীণ ব্যাংক’ প্রতিষ্ঠা করেন।
মৃক্তিযুদ্ধে ড. মুহাম্মদ ইউনূস :
১৯৭১ সালে যখন বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ চলছিল, তখন আমেরিকায় পড়াশোনা করতেন গরিবের এই ব্যাংকার। মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে জনমত গড়তে সুদূর আমেরিকায় নিরলস কাজ করে গেছেন তিনি। সমৃদ্ধ ক্যারিয়ারের অধিকারী এই বাংলাদেশি সেখানে প্রতিষ্ঠা করেন বাংলাদেশি নাগরিক কমিটি। চালু করেন বাংলাদেশ তথ্য কেন্দ্র। আমেরিকার তৎকালীন পাকিস্তানি দূতাবাসে কর্মরত বাংলাদেশি অফিসারদের সেখান থেকে বের হবার জন্য সাহায্য করেন। সদস্য ছিলেন বাংলাদেশ ডিফেন্স লিগেরও। এ দলটি মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র ও অন্যান্য সাহায্য সহযোগিতা দিতো।
ড. মুহাম্মদ ইউনূস এর জীবনাদর্শ :
খুব সাধারণ ও সাদাসিধে মানুষ ড. মুহাম্মদ ইউনূস। রাগ কম। অহঙ্কার তার কাছে ঘেঁষতে পারে নি। কথা বলেন গুছিয়ে। তাঁর হাসিতে দ্যুতি খেলে। যে হাসিতে গরিব মানুষ তার কষ্ট ভুলে যান। তিনি ছুটে যান গ্রাম থেকে গ্রামে। মানুষের জন্য জামানত ছাড়া ঋণ নিয়ে। জোবরা গ্রাম তেভাগা সমিতি থেকে আজকের গ্রামীণ ব্যাংক। কাজের মধ্যে ডুবে থাকেন। কাজের মধ্যেই আনন্দ খুঁজে পান। তাঁর আলাদা কোন দামি গাড়ি-বাড়ি নেই। তিনি কখনো কখনো অফিসের মাইক্রো অথবা জিপ ব্যবহার করেন। অফিস ঘরে তার বিশেষ গদি আঁটা চেয়ার নেই। কাঠের চেয়ার-টেবিল ব্যবহার করেন তিনি। গ্রামীণ চেকের ফতুয়া পারেন তিনি। গ্যাবাডিন কাপড়ের নরমাল-কাট প্যান্ট পরেন সঙ্গে। বাসায় লুঙ্গি পরেন। পায়ে চামড়ার স্যান্ডেলই ব্যবহার করেন। এ পোশাকেই তিনি দেশ থেকে দেশে, গ্রাম থেকে গ্রামে ঘুরে বেড়ান। বিশ্বের দেশে দেশে সবখানেই একই পোশাকে ইউনূস হাজির হন। এতেই তিনি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। নিঃসঙ্কোচে সব মানুষের সঙ্গে মেশেন। কোনো কৃত্রিমতা নেই। প্রাণখুলে কথা বলেন। মানুষের কথা শোনেন। মানুষকে আশার কথা শোনান।
ইউনূসের গ্রামীণ ব্যাংক :
ড. মুহাম্মদ ইউনূস দারিদ্র্য দূরীকরণে ক্ষুদ্র ঋণের প্রবর্তক হিসেবে বিশ্বব্যাপী পরিচিত। তিনি এই ঋণের সুযোগ মূলত সবচেয়ে গরিব ও অসহায় নারীদের জন্য চালু করেন। পুরুষরাও এই ঋণ পেতে পারেন, তবে অগ্রাধিকার নারীদেরই দেওয়া হয়। তার মতে, দারিদ্র্য হলো এক ধরনের অস্বাভাবিক পঙ্গুত্ব—যেমন বনসাই গাছ, যেটি স্বাভাবিকভাবে বড় হতে পারত, কিন্তু কৃত্রিমভাবে তাকে খর্ব করা হয়েছে। গ্রামীণ ব্যাংক কোনো এনজিও নয় এবং এটি দাতাদের উপর নির্ভরশীলও নয়। এই ব্যাংকের ঋণ ফেরতের হার প্রায় শতভাগ, যা সাধারণ ব্যাংকিং ব্যবস্থায় কল্পনাও করা যায় না। দেশে বড় ঋণ যত বড়, ঋণ খেলাপিও তত বড়। কিন্তু গ্রামীণ ব্যাংক গ্রামের দরিদ্র মানুষ, বিশেষ করে নারীদের কাছে সহজে ঋণ পৌঁছে দিয়ে তাদের জীবনে বিপ্লব এনেছে। নারীর ক্ষমতায়নে দেশে যত কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তার মধ্যে ড. ইউনূসের গ্রামীণ ব্যাংক সবচেয়ে সফল ও গৌরবময় উদ্যোগ হিসেবে স্বীকৃত।
নোবেল শান্তি পুরস্কার অর্জন :
২০০৬ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার অর্জন করেন বাংলাদেশের বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং তাঁর গ্রামীণ ব্যাংক। যেটি ক্ষুদ্র ঋণদান কর্মসূচির মাধ্যমে পল্লী অঞ্চলের দরিদ্র নারীদের অভাবমুক্ত করার ক্ষেত্রে অগ্রদূতের ভূমিকা পালন করেছে।
বাঙালী হিসেবে তৃতীয় এবং বাংলাদেশি প্রথম ব্যক্তি হিসেবে তাঁর এ পুরস্কার প্রাপ্তিতে বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি গৌরবান্বিত হয়েছে। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নোবেল প্রাপ্তি একটি বড় ঘটনা। এই-ই প্রথম একজন অর্থনীতিবিদ ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে এ পুরস্কার প্রদান করা হয়।
যে ছয়টি বিষয়ে নোবেল শান্তি পুরস্কার দেয়া হয়, তার মধ্যে মান্তি পুরস্কার ছাড়া সব ক’টি স্টকহোমে রয়্যাল সুইডিশ সায়েন্স একাডেমি থেকে দেয়া হয়। নোবেল শান্তি পুরস্কার প্রদান করা হয় নরওয়ের রাজধানী অসলো থেকে। অসলো সিটি হলে এ পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। গত ১৩ অক্টোবর, ২০০৬ শুক্রবার নোবেল কমিটির ঘোষণাপত্রে বলা হয়, তৃণমূল পর্যায় থেকে অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ ড. মুহাম্মদ ইউনূসও গ্রামীণ ব্যাংককে সমান দুইভাগে ২০০৬ সালের নোবেল শান্তি পুরস্কার দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে নোবেল কমিটি। ঘোষণাপত্রে আরও বলা হয়, বিশাল জনগোষ্ঠী যদি দারিদ্র্য থেকে বেরিয়ে আসার পথ না পায় তাহলে টেকসই শান্তি অর্জন সম্ভব নয়। ক্ষুদ্র ঋণের ক্ষেত্রে গ্রামীণ ব্যাংক বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের জন্য বিরাট মডেল ও আদর্শের উৎস হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।
ড. মুহম্মাদ ইউনূসের এ বিশাল প্রাপ্তিতে বাংলাদেশের ১৫ কোটি জনতা আনন্দে আত্মহারা। অভিনন্দন আবারো ড. ইউনূসকে এবং এদেশের লক্ষ কোটি সৎ এবং পরিশ্রমী নারীদেরকে। তাঁর এ প্রাপ্তি পুরো বাংলাদেশের প্রাপ্তি। এ বিজয় পুরো বাংলাদেশের বিজয়। চট্টগ্রামের জোবরা গ্রামে স্বল্প পরিসরে যাত্রা শুরু করা ক্ষুদ্র ঋণ প্রকল্প আজ সারা বিশ্বে সমাদৃত। সমাদৃত পুরো বাংলাদেশ। বাংলাদেশের পরিচয় হচ্ছে- বিশ্বকবির সোনার বাংলা, নজরুলের বাংলাদেশ, জীবনানন্দের রূপসী বাংলা রূপের যে তার নেইকো শেষ। এখন থেকে এ পরিচয়ের সঙ্গে আরও যুক্ত হবে ইউনূসের বাংলাদেশ এবং দারিদ্র জনগোষ্ঠী বিশেষ করে নারীদের সততার বাংলাদেশ।
উপসংহার :
যারা দরিদ্র চিরজীবনের জন্য দরিদ্র থাকবে, যারা বঞ্চিত তারা চিরকালই অবহেলার শিকার হবে- এটা হতে পারে না। এজন্যই বঞ্চিত মানুষকে তাদের অর্থনৈতিক অধিকার ফিরে দিতে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের মতো মহন ব্যক্তি দীর্ঘদিন কাজ করে যাচ্ছেন। এই কাজ এই মহান ব্যক্তিকে অনুসরণ করে হৃদয়বান ব্যক্তিরা এগিয়ে এলেই হবে নোবেল শান্তি পুরস্কার পাওয়ার সার্থকতা।
আপনি যদি আরও রচনা পড়তে চান, তাহলে আমাদের ওয়েবসাইটে যান এবং আরও রচনাগুলি পড়ুন। StudyTika.com এ রয়েছে নানা ধরনের রচনা।