বাংলাদেশের লোকশিল্প রচনা Class 7 8 9 10 ‍SSC HSC (২০+ পয়েন্ট)

বাংলাদেশের লোকশিল্প আমাদের দেশের ঐতিহ্যের এক অমূল্য অংশ। এই রচনাতে আপনি জানতে পারবেন লোকশিল্পের বিভিন্ন দিক এবং এর গুরুত্ব। আসুন, এই রচনাটি পড়ুন এবং বাংলাদেশের লোকশিল্প সম্পর্কে আরো জানুন।

বাংলাদেশের লোকশিল্প রচনা Class 7 8 9 10 ‍SSC HSC (২

 বাংলাদেশের লোকশিল্প রচনা ১

 ভূমিকা  

ধর্মীয় ও সামাজিক প্রয়োজনকে কেন্দ্র করে লোকশিল্পের উদ্ভব। আলপনা, মনসাঘট, লক্ষ্মীর সরা, মঙ্গলঘট ইত্যাদি সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানের সঙ্গে সম্পৃক্ত বিভিন্ন লোকশিল্প। পটচিত্রে ধর্মীয় আবেগ যুক্ত থাকলেও তা জীবিকার উপায় হিসেবে গণ্য। নানারকম ডিজাইন ও অলংকরণে শোভিত আসবাবপত্র ও যন্ত্রপাতি গৃহস্থের ব্যবহারিক প্রয়োজন মেটায়। 

খেলার পুতুল, শখের হাঁড়ি, সোনা-রুপার অলংকার প্রভৃতি সাধারণত শৌখিন দ্রব্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়। তবে ধর্মীয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিটি শিল্পেই থাকে এক ধরনের নান্দনিকতা। তাই হিংস্র পশু কিংবা রাক্ষসের মুখোশচিত্র দেখতে যতই ভয়ঙ্কর হোক না কেন, শিল্পীর সৃষ্টিশীলতা, ঐতিহ্য এবং আবেগের মিশ্রণে তাতে এক ধরনের রস তৈরি হয়, যাকে বলা হয় বীভৎস রস।

লোকশিল্প কী  

ঘরে বসে যে পণ্য উৎপাদন করা হয় বা পরিবারের ক্ষুদ্রাকার ও সামান্য মূলধন কাজে লাগিয়ে স্থানীয় কাঁচামালের- ভিত্তিতে যে শিল্প গড়ে ওঠে তাকে লোকশিল্প বলে। এ ধরনের শিল্প সাধারণত ব্যক্তির দ্বারা অথবা পরিবারের সদস্য দ্বারা পরিচালিত হয়। প্রয়োজনে সেখানে মজুরির বিনিময়ে বাড়তি শ্রমিকও নিয়োগ করা যায় ।

বাংলাদেশের লোকশিল্প  

বাংলাদেশ লোকশিল্পের দেশ। লোকশিল্প আমাদের গৌরব, আমাদের ঐতিহ্য। শুধু দেশেই নয়, বিদেশেও পণ্য পাঠিয়ে আমাদের লোকশিল্প বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছে। এ দেশের লোকশিল্পের খ্যাতি বিশ্বজোড়া। বিশেষ করে ঢাকার মসলিনের গৌরব আজও কিংবদন্তি হয়ে আছে দুনিয়ায় ।

ঢাকাই মসলিন  

বাংলাদেশের লোকশিল্প বললেই সবার আগে চোখে ভাসে ঢাকাই মসলিনের কথা। ঢাকার ডেমরা এলাকার তাঁতিদের নিপুণ হাতে তৈরি এই দুষ্প্রাপ্য কাপড় এক সময় সারা বিশ্বে ব্যাপক সাড়া ফেলেছিল। মোগল আমলে এটি রাজাদের বিলাসবহুল পোশাকের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল। এতটাই সূক্ষ্ম হতো এই মসলিন যে, একটি শাড়ি সহজেই একটি দিয়াশলাইয়ের খাপে রাখা যেত। বিদেশেও এই কাপড়ের ছিল দারুণ কদর। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে এই ঐতিহাসিক শিল্প আজ হারিয়ে গেছে।

নকশিকাঁথা  

নকশিকাঁথা একটি অন্যতম প্রধান গ্রামীণ লোকশিল্প। একসময় বাংলাদেশের গ্রামে গ্রামে নকশিকাঁথা তৈরির রেওয়াজ ছিল। বর্ষাকাল ছিল নকশিকাঁথা সেলাইয়ের উপযুক্ত সময়। এ সময় গ্রামের মেয়েরা সংসারের কাজ শেষ করে দুপুরে খাওয়া-দাওয়া শেষে, পাটি বিছিয়ে নকশিকাঁথা সেলাই করতে বসত। তারা মনের মাধুরী মিশিয়ে এ কাঁথার ওপর বিচিত্র রকমের নকশা ফুটিয়ে তুলত।

জামদানি শাড়ি  

লোকশিল্পের আর একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো জামদানি শাড়ি। নারায়ণগঞ্জ জেলার নওয়াপাড়া জামদানি কারিগরদের বসবাস। শতাব্দীকাল ধরে, শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে এ তাঁত শিল্প বিস্তার লাভ করেছে। এক বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণে দেখা যায় যে, শীতলক্ষ্যা নদীর পানির বাষ্প থেকে যে আর্দ্রতার সৃষ্টি হয় তা জামদানি বোনার জন্য খুবই উপযোগী। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণেই বর্তমানে শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে অনেক কাপড়ের কারখানা গড়ে উঠেছে।

খাদি বা খদ্দর  

খাদি বা খদ্দরের প্রচুর কদর রয়েছে এদেশের গ্রাম ও শহরে। খাদি কাপড়ের বিশেষত্ব হলো এর সবটাই হাতে তৈরি। তুলা থেকে হাতে সুতা কাটা হয়। এদেশের গ্রামে বাড়ির আশপাশে তুলার গাছ লাগানোর রীতি আছে। সেই গাছ থেকে উৎপাদিত তুলা দিয়ে সুতা কাটা ও হস্তচালিত তাঁতে এসব সুতা দিয়ে কাপড় প্রস্তুত করা হতো, সেটাই হলো খাদি কাপড় ।

কাঁসা ও পিতলের তৈজসপত্র  

একসময় এদেশের গ্রামে গ্রামে কাঁসা ও পিতলের তৈরি আসবাবপত্র প্রচলিত ছিল। আজও শত শত কারিগর তৈরি করে বিচিত্র ধরনের তৈজসপত্র। মাটির ছাঁচে গলিত কাসা ঢেলে বিভিন্ন আকৃতির তৈজসপত্র তৈরি করা হয় ৷ এছাড়াও গ্রামে-গঞ্জে বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে আছে বিভিন্ন ধরনের লোকশিল্প। পোড়ামাটির কাজের ঐতিহ্য এদেশে বহু যুগের। প্রাচীনকাল হতে মাটির তৈরি কলস, হাড়ি, পাতিল, সানকি, ফুলদানি, দইয়ের ভাঁড় প্রভৃতি ব্যবহৃত হয়ে আসছে। 

লোকশিল্পের সংরক্ষণ  

যান্ত্রিক সভ্যতা তথা শিল্পবিপ্লবের প্রভাবে আমাদের ঐতিহ্যবাহী লোকশিল্প আজ বিলুপ্ত প্রায় । লোকশিল্পের পুনর্জাগরণের মধ্য দিয়েই আবার নতুন উৎসাহ-উদ্দীপনা সৃষ্টি হবে। লোকশিল্পই এদেশের গ্রামীণ অর্থনীতির বুনিয়াদ । তার গৌরবময় ইতিহাসের পুনরুজ্জীবনই দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির মরাগাঙে সমৃদ্ধির ঘ্রাণ আনতে পারে। বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণ তথা লোকশিল্পের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য যান্ত্রিক শিল্পের পাশাপাশি আমাদের কুটিরশিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে।

উপসংহার  

লোকশিল্প আমাদের ঐতিহ্য ও গৌরবের প্রতীক। বাংলাদেশের বেকার সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রেও লোকশিল্পের ভূমিকা রয়েছে। তাই দেশের লোকশিল্পকে আরও উন্নত, মজবুত ও সম্প্রসারিত করা প্রয়োজন। বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে দরিদ্র জনসাধারণের ভাগ্য পরিবর্তনে লোকশিল্পের প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব অপরিসীম।

(একই রচনা আরেকটি বই থেকে সংগ্রহ করে দেয়া হলো)

 বাংলাদেশের লোকশিল্প রচনা ২


ভূমিকা : প্রাচীন কাল থেকেই বাঙালিরা মৌসুমী কাজের অবসরের ফাঁকে ফাঁকে হরেক রকমের কারুশিল্প সৃষ্টি করতো। এগুলোর মধ্যে সুচি শিল্প, তাঁত শিল্প, নকশিকাঁথা ও মসলিন বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। গৃহিণীরা কাজের বিশ্রামে নকশিকাঁথা কিংবা নানারূপ কারুময় শিল্পকলা অনায়াসে সৃষ্টি করে ফেলতো। এসবের সুনাম বহুকাল আগেই বিদেশেও ছড়িয়েছে। আমাদের লোকশিল্প আমাদের সমৃদ্ধ ঐতিহ্যের পরিচায়ক। 

লোকশিল্পের পরিচয় : লোকশিল্প সাধারণ লোকের জন্য সাধারণ লোকের সৃষ্টি। এর পরিধি এত ব্যাপক ও প্রকৃতি এত বিচিত্র যে, এক কথায় এর সংজ্ঞা নিরূপণ করা যায় না। অগাস্ট প্যানিয়েলা (August Panella) বলেন, লোকশিল্পের কেবল ‘শিল্প’ শব্দ বোঝা কঠিন নয়, ‘লোক’ শব্দও সমান সমস্যাপূর্ণ। তাঁর ভাষায়, ‘In the expression ‘Folk art’ it is not only the word ‘art’ that is difficult to understand, the word ‘Folk’ is equally problematic.’ বিশেষজ্ঞরা লোকশিল্পের সংজ্ঞা এড়িয়ে যান এ বলে যে, দেখলেই তাকে চেনা যাবে। ‘Know it when you see it. Material will define itself if one would allow it to so.’ 

সবচেয়ে সহজলভ্য উপাদান মাটি থেকে আরম্ভ করে কাঠ, বাঁশ, বেত, পাতা, সুতা, লোহা, তামা-সোনা-রূপা, ধাতব দ্রব্য, সোলা, পাট, পুঁতি, ঝিনুক, চামড়া, পর্যন্ত নানা উপাদান লোকশিল্প নির্মাণে ব্যবহৃত হয়। কামার, কুমার, ছুতার, তাঁতি, কাঁসারু, সোনারু, শাঁখারি, পটুয়া, প্রভৃতি পেশাদার এবং অন্য অনেক অপেশাদার নর-নারী লোকশিল্পের নির্মাতা। এরূপ বিভিন্ন ও শ্রেণী প্রকৃতির লোকশিল্পের সংজ্ঞায়ন সত্যিই দুঃসাধ্য ব্যাপার। 

সুতরাং লোকশিল্পী পূর্বপুরুষের কাছ থেকে জ্ঞান আহরণ করে সমাজের মানুষের চাহিদা ও উপযোগিতার কথা বিবেচনায় রেখে মনের মাধুরী মিশিয়ে প্রথাগতভাবে যে শিল্প গড়ে, তাকেই লোকশিল্প হিসেবে আখ্যা দেয়া যায়। 

লোকশিল্পের শ্রেণীবিভাগ : ফোকলোরের তিনটি প্রধান ধারা রয়েছে। যথা : মৌখিক (oral), বস্তুগত (material) ও অঙ্গক্রিয়াগত (performing)। লোকজ চারু ও কারুশিল্প একত্রে ‘লোকশিল্প’ নামে অভিহিত। লোকশিল্পের তিনটি প্রধান শাখা রয়েছে। যথা: চিত্র, ভাস্কর্য ও স্থাপত্য। প্রতি শাখার আবার নানা উপবিভাগ রয়েছে। উপকরণ, ক্যানভাস ও রীতি অনুযায়ী উন্নত শিল্পের মতো লোকশিল্পেরও নিম্নরূপ শ্রেণীকরণ করা যায় : 
ক. অঙ্কন ও নকশা 
খ. সূচিকর্ম 
গ. বয়নশিল্প 
ঘ. আদর্শায়ন 
ঙ. ভাস্করণ 
চ. স্থাপত্যশিল্প 

নিচে উল্লিখিত শ্রেণীবিভাগ অনুযায়ী কয়েকটি লোকশিল্পজাত বস্তুর নাম, আধার, উপকরণ ও শিল্পীর নাম আলোচনা করা হলো : 

ক. অঙ্কন 

১. আল্পনা : বর্তমানে ধর্মীয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে আল্পনা আঁকা সাধারণ রীতিতে পরিণত হয়েছে। লোকশিল্পের এ ধারাটি শিক্ষিত সমাজেও উঠে এসেছে। লোকশিল্পের এটি একটি জনপ্রিয় শাখা, এতে রঙ-তুলির ব্যবহার আছে। সাধারণত মেঝে, দেওয়াল, কুলা, পিঁড়ি, ঘরের খুঁটি, দুয়ার, পূজার দেবী, সরা, কলস, ঝাঁপি ইত্যাদি আধার বা পাত্রে আল্পনা আঁকা হয়। 

২. পটচিত্র : পটচিত্র আর একটি মাধ্যম, যা এ দেশের লোকঐতিহ্যের সাথে জড়িত। আল্পনার রূপকার নারীসমাজ, পটচিত্রের রূপকার মূলত পুরুষ, তবে এর জটিল প্রক্রিয়ায় নারীরাও অংশগ্রহণ করে থাকে। এদিক থেকে পটচিত্র একটি যৌথশিল্প। 

৩. উল্কি : উল্কি লোকশিল্পের একটি চিরস্থায়ী ধারার অংশ। বিশ্বের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে শরীরের বিভিন্ন স্থানে উল্কি আঁকার ও রাখার প্রথা দীর্ঘদিন ধরেই চলে আসছে। আফ্রিকার কিছু উপজাতি তাদের শরীরজুড়ে নানা রকম রঙ ও নকশার উল্কি ধারণ করে। উল্কি অঙ্কনের পেছনে ধর্মীয় বিশ্বাস, চিকিৎসা, বার্তা বিনিময়, কিংবা সৌন্দর্যচর্চার মতো নানা উদ্দেশ্য কাজ করে। আমাদের দেশেও বৈরাগী ও বৌষ্টামীরা প্রায়ই বাহুতে রাধাকৃষ্ণের যুগলমূর্তির উল্কি ধারণ করে। আজকাল শহরের অনেক তরুণ-তরুণী ফ্যাশনের অংশ হিসেবে শরীরে উল্কি আঁকছে।

৪. পুতুলচিত্র : ছুতার, কুমার, মালাকার এবং গৃহস্থ বালিকারা রঙ এবং রঙিন সুতার সাহায্যে পুতুলচিত্র তৈরি করে। পুতুলচিত্র তৈরির উপকরণ হলো কাঠ, কাপড়, মাটি, শোলা ইত্যাদি। 

৫. খেলনাচিত্র : গ্রামবাংলার গৃহস্থ নরনারীরা কাঠ বা মাটিনির্মিত খেলনার ওপর রঙের সাহায্যে বিভিন্ন চিত্র এঁকে খেলনাচিত্র তৈরি করেন। 

খ. বয়নশিল্প 

১. নকশি পাটি : নকশি পাটি বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী লোকশিল্প। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের লোকশিল্পীরা রঙিন বেত দিয়ে অত্যন্ত সুন্দর ও চমৎকার নকশি পাটি তৈরি করে থাকেন। 

২. নকশি পাখা : গ্রামবাংলার আরেকটি ঐতিহ্যবাহী বয়নশিল্প নকশি পাখা। গৃহস্থ নারীরা অত্যন্ত শখ করে পাতা বা সুতার টানার ওপর রঙে রঙিন সুতা এবং পাটের মাধ্যমে নকশি পাখা তৈরি করেন। 

৩. ঝুড়ি, কুলা-ডালা, ফুলচাঙ্গা : এ দেশের ঐতিহ্যবাহী নয়নশিল্পের অন্যতম হলো বেত ও বাঁশের জো-এর তৈরি ঝুড়ি, কুলা-ডালা ও ফুলচাঙ্গা। ঝুড়ি এবং কুলা-ডালা তৈরি করে যে সকল লোকশিল্পী তাদেরকে ডোম জাতি বলা হয়। আর সাধারণত গৃহস্থ রমণীরা ফুলচাঙ্গা তৈরি করে। 

গ. সূচিকর্ম 

১. নকশি কাঁথা : নকশি কাঁথা নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের লোকশিল্পের সবচেয়ে মনোরম নিদর্শন। নকশি কাঁথা সূচিকর্মের অন্তর্ভুক্ত। কয়েক ফালি কাপড় স্তর পরস্পরায় সাজিয়ে কাঁথার জমিন তৈরি করা হয়। সাধারণ ব্যবহার্য সূচে রঙ-বেরঙের সুতা পরিয়ে ‘ফোঁড়’ দ্বারা এ জমিনে ছবি আঁকা হয়। 

২. নকশি কাঁথার ছবি ও নকশা : নকশি কাঁথাকে সাধারণত মাছ, পাতা, তারা, বৃক্ষ, ঘোড়া, হাতি, বেদ-দেবীর ছবি অথবা কোনো গ্রামীণ ঘটনার ছবি বুনন করা হয়। পাহাড়-পর্বত, পশু-পাখি, প্রসাধনী দ্রব্য, রান্নাঘরের জিনিসপত্র, পালকী, মটর, গ্রাম্যমেলা, জ্যামিতিক নকশা, ফুল ও নানা ধরনের আল্পনা এবং শ্লোক, নানা ফিগার মোটিফ এতে দেখতে পাওয়া যায়। 

৩. নকশি কাঁথার প্রকার : লোকশিল্প হিসেবে নকশি কাঁথা আমাদের ব্যক্তিগত, সামাজিক ও ধর্মীয় কাজে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। ব্যবহারিক দিক থেকে নকশি কাঁথাকে চারটি ভাগে ভাগ করা যায়— লেপ, ঢাকনা, ওশার ও থলে। এদের মধ্যে লেপ ও ঢাকনা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। লেপকাঁথা আবার দুই ধরনের হয়— একটি দোরখা এবং অন্যটি আঁচল বুননী।

ঘ. আদর্শায়ন 
লোকশিল্পের অন্যতম প্রধান শাখা এই আদর্শায়ন। পুতুল, খেলনা, হাঁড়ি-পাতিল, দেবমূর্তি, মুখোশ, মুকুট, নকশি পিঠা, মিষ্টি, নৌকা, তাজিয়া, রথ, শৌখিন দ্রব্য, পাল্কি, গাড়ি ইত্যাদি সবই আদর্শায়নের অন্তর্ভুক্ত লোকশিল্পজাত বস্তু। 

১. পুতুল : কুমার, ছুতার, গৃহস্থ রমণী ও বালিকারা মাটি, কাঠ, কাপড়, সুতা, পাট, ধাতু ইত্যাদির সাহায্যে মাটির পুতুল, কাঠের পুতুল, কাপড়ের পুতুল, ধাতুর পুতুল ইত্যাদি তৈরি করেন। 

২. খেলনা : মাটি, কাঠ, শোলা ও ধাতুর সাহায্যে কুমার, ছুতার, গৃহস্থ ব্যক্তি ও মহিলারা শিশু-কিশোরদের জন্য নানা রকমের খেলনা তৈরি করেন। এই ধরনের খেলনার মাঝে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের পশু-পাখি, মানুষ, হাঁড়ি-পাতিল ইত্যাদির প্রতিকৃতি। 

৩. দেবমূর্তি : হিন্দুদের দেবমূর্তি একটি উল্লেখযোগ্য লোকশিল্প। পেশাদার কুমার মাটি, বাঁশ, কাঠ, সুতা, শোলা, ধাতু, কাপড়, রঙ ইত্যাদি উপকরণের সাহায্যে হিন্দুদের নানা দেবদেবীর মূর্তি তৈরি করেন। 

৪. নকশি পিঠা : বাংলার নারীমনের শিল্প সৌন্দর্যের প্রকাশ নকশি পিঠা। এতে আছে যুগ-যুগান্তরের বাংলার অন্তঃপুরিকাদের চিন্তা, চেতনা ও রসবোধ। 

ঙ. ভাস্করণ : কাঠখোদাই শিল্প (প্রধানত মূর্তি ও নকশা খোদাই), ধাতুর নকশা, পোড়ামাটির ফলকচিত্র ইত্যাদি হলো লোকশিল্পের অন্তর্ভুক্ত ভাস্করণের নিদর্শন। বাড়ি, দরজা, জানালা, বেড়া, খাট, পালঙ্ক, বাক্স, সিন্দুক, বাদ্যযন্ত্র ইত্যাদি তৈরির ক্ষেত্রে ছুতার কাঠ খোদাই করে বিভিন্ন রকমের দৃষ্টিনন্দন নকশা ও ডিজাইন তৈরি করেন। 

চ. স্থাপত্যশিল্প : বাংলাদেশের স্থাপত্যশিল্পে লোকশিল্পের গভীর প্রভাব স্পষ্টভাবে দেখা যায়। ঘর-বাড়ি, দালান-কোঠা, মসজিদ, মন্দিরসহ নানা ধরনের স্থাপনা নির্মাণে ঘরামি, ছুতার ও রাজমিস্ত্রিরা বিশেষ নকশা ও নৈপুণ্যের মাধ্যমে এগুলো তৈরি করেন। এসব নির্মাণকাজে সাধারণত মাটি, মাঠ, বাঁশ, খড়, দড়ি ইত্যাদি দেশীয় উপকরণ ব্যবহার করা হয়।

লোকশিল্প সংগ্রহের গুরুত্ব : লোকশিল্প যে কোনো জাতির ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সাথে সম্পর্কিত একটি গুরুত্বপূর্ণ শিল্প। তাই একটি জাতির আত্মপরিচয় সম্পূর্ণভাবে জানার জন্য লোকশিল্প সংগ্রহের গুরুত্ব অপরিসীম। এ সম্পর্কে বিখ্যাত লোকবিজ্ঞানী আশুতোষ ভট্টচার্য বলেন, ‘লোক-সংস্কৃতির রূপ-রসগত বহুমুখী আলোচনাই এর সব নয়, এর জন্য তাত্ত্বিক আলোচনা প্রয়োজন। কিন্তু এ কথা সত্য, তাত্ত্বিক আলোচনার পূর্বে এর উপকরণের যথাসম্ভব সামগ্রিক সংগ্রাম আবশ্যক।’ 

লোকশিল্প সংগ্রহের সমস্যা : লোকশিল্পজাত বস্তু সংগ্রহের সমস্যা ও অসুবিধা অনেক। অনেক সময় লোকশিল্পী তার নিজস্ব সৃষ্টি হস্তান্তর করতে অনীহা প্রকাশ করেন। কারণ, শিল্পী সৃষ্টির আনন্দে তাঁর শিল্পকর্মে ব্রতী হন তাই নিজের সৃষ্টির প্রতি মমত্ববোধের জন্য তিনি হাতের তৈরি জিনিস সহজে হাতছাড়া করতে চান না। পূর্বপুরুষের স্মৃতিবিজড়িত অতি পুরাতন লোকশিল্পজাত বস্তু পরিবারের ঐতিহ্য হিসেবে ধরে রাখতে চান শিল্পীর উত্তরাধিকারী। 

লোকশিল্প সংরক্ষণের সমস্যা : সংগৃহীত সামগ্রীর সংরক্ষণেও সমস্যা আছে। সাধারণত ভঙ্গুর ও ক্ষণস্থায়ী উপাদানে লোকশিল্প সৃষ্টি করা হয়। ফলে এগুলোর স্থায়িত্ব কম। বাঁশ, বেত, সুতা, পাতা প্রভৃতির ক্ষেত্রে এ সমস্যা দেখা দেয়। লোকশিল্পীরা যে রঙ ব্যবহার করেন তারও স্থায়িত্ব নেই। তাছাড়া প্রতিকূল আবহাওয়ায় সংগৃহীত, সামগ্রী ধীরে ধীরে নষ্ট হয়ে যায়। 

লোকশিল্প সংরক্ষণের উদ্যোগ : লোকশিল্পের সংগ্রহ দু রকমের হতে পারে। যথা – বাস্তব সংগ্রহ এবং দলিলায়ন। বাস্তব সংগ্রহের জন্য প্রয়োজন সংগ্রশালা বা জাদুঘর। লোকশিল্পের পঠন-পাঠন ও সংগ্রহের জন্য ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন গঠন করা হয়। বাংলার এককালের রাজধানী সোনারগাঁয়ে লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশনের সদর দপ্তর এবং লোকশিল্প জাদুঘরের স্থান নির্বাচন করা হয়। ১৯৭৬ সালের অক্টোবর মাসে সর্দার বাড়ি নামক এক পুরনো জমিদার বাড়ি মেরামত করে তাতে লোকশিল্প যাদুঘর স্থাপিত হয়। লোকশিল্পের নানা নিদর্শন এ সংগ্রহশালায় স্থান পেয়েছে। 

এছাড়া জাতীয় জাদুঘর, চট্টগ্রামের জাতিতত্ত্ব জাদুঘর, রাঙামাটির ট্রাইবাল কালচারাল একাডেমি ও নেত্রকোনার বিরিশিরি ট্রাইবাল একাডেমিতে উপজাতীয় শিল্পের সংগ্রহ আছে। মহাস্থানগড়, পাহাড়পুর ও ময়নামতির প্রত্নতাত্ত্বিক জাদুঘরের লোকশিল্পের নিদর্শনের মধ্যে মাটির ফলকচিত্র উল্লেখযোগ্য। তাছাড়া দিনাজপুর, কিশোরগঞ্জ, ত্রিশাল প্রভৃতি আঞ্চলিক জাদুঘরে কিছু কিছু লোকশিল্পের নিদর্শন রক্ষিত আছে। 

উপসংহার : বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থায় লোকশিল্পের প্রয়োজন বা উপযোগিতা জাতিতাত্ত্বিক দিক দিয়ে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। কিন্তু লোকশিল্পের অনেক উপাদানই আজ বিলুপ্তির পথে। এমতাবস্থায় লোকশিল্পের নমুনা সংগ্রহ ও সংরক্ষণ, সেগুলোর উৎস-ইতিহাস ও শিল্প-বিচার এবং জরুরি হয়ে পড়েছে। আবহমান বাংলার ঐতিহ্য ও গৌরবকে ধরে রাখার স্বার্থে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে লোকশিল্পের জন্য আর্থিক বিনিয়োগ ও বাজারজাত ব্যবস্থা উন্নত করতে হবে। দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য লোকশিল্পীদের উৎসাহ বাড়াতে হবে। এতে লোকশিল্পসহ আমাদের হারানো দিনের অনেক ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি কিছুটা হলেও রক্ষা পাবে।

এই রচনার মাধ্যমে বাংলাদেশের লোকশিল্প সম্পর্কে বিস্তারিত জানার পর আপনি আরও রচনা পড়তে পারেন আমার ওয়েবসাইটে। আরও রচনা পড়ুন StudyTika.com এ।

Getting Info...

إرسال تعليق

Oops!
It seems there is something wrong with your internet connection. Please connect to the internet and start browsing again.