আজকের পৃথিবীতে পরিবেশ দূষণ একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই রচনায় আমরা পরিবেশ দূষণ এবং তার প্রতিকার নিয়ে আলোচনা করেছি। আসুন, পড়ে দেখি কীভাবে আমরা এই সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে পারি।
পরিবেশ দূষণ ও তার প্রতিকার রচনা
ভূমিকা : বর্তমান বিশ্বে পরিবেশ দূষণ একটি গুরুতর সমস্যা। একটু চারপাশে তাকালেই বোঝা যায়, আমাদের অসচেতনতা ও অবহেলার কারণেই প্রতিদিন আমরা নিজেরাই সৃষ্টি করছি এক বিষাক্ত পরিবেশ। এর ফলে আমরা শুধু নিজেদের নয়, ভবিষ্যৎ প্রজন্মকেও ঠেলে দিচ্ছি ধ্বংসের দিকে। তাই পরিবেশের এই অবনতি এখন আমাদের জীবনের জন্য বড় এক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বাংলাদেশের পরিবেশ ধ্বংসকারী বিভিন্ন মাধ্যম বা উপাদান : এক সময় বাংলাদেশ ছিল প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের লীলাভূমি, এর মাঠ-ঘাট, পাহাড়, নদী-নালা, বায়ু সবকিছুই ছিল বিশুদ্ধ আর নির্মল। কিন্তু বড়ই পরিতাপের বিষয় মানুষের তথা প্রাণীকূলের বেঁচে থাকার পরিবেশের প্রধান তিনটি উপাদান, যথা-মাটি, পানি ও বায়ু নানা উপায়ে দূষিত হচ্ছে; এ দূষণ আমরা ঘটাচ্ছি কখনো জেনে আবার কখনো না জেনে। যে সকল বিভিন্ন উপায় বা মাধ্যমে বাংলাদেশের পরিবেশ ক্ষতির সম্মুখীন হয় সেগুলো নিম্নে আলোচিত হলো :
১. পলিথিন : বাংলাদেশে পলিথিন নিষিদ্ধ করা হলেও তা রূপ পরিবর্তন করে বিভিন্নভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। পলিথিন নামক এ বিপদজনক দ্রব্যটির যাত্রা শুরু হয় আশির দশকের গোড়ার দিকে। বর্জ্য হিসেবে পলিথিন এই সভ্যতার এক ভয়াবহ শত্রু। বিশ্বজুড়ে পরিবেশ বিজ্ঞানীদের সাবধান বাণী থাকা সত্ত্বেও পলিথিন সামগ্রীক ব্যবহার এ দেশে বেড়েছে আশঙ্কাজনকভাবে। পলিথিন এক অবিনাশী বর্জ্য, যেখানেই ফেলা হোক না কেন এর শেষ নেই। পোড়ালে এই পলিথিন থেকে যে ধোঁয়া বের হয় তা-ও পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। তবে ২০০২ সালের ১ মার্চ সরকার সারা দেশে পলিথিনের শপিং ব্যাগ নিষিদ্ধ করেছে।
২. বন উজাড় : যে কোনো দেশের পরিবেশে বনভূমি বিশেষ ভূমিকা পালন করে। বনভূমির ওপর দেশের পরিবেশগত ভারসাম্য বহুলাংশে নির্ভরশীল। কোনো দেশে পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য দেশের বনভূমির পরিমাণ ১০ শতাংশেরও কম। সরকারি হিসেবে বনভূমির পরিমাণ ১৭.৫ শতাংশ। বনভূমি উজাড় আমাদের দেশের পরিবেশগত সমস্যার অন্যতম কারণ।
৩. পানিতে আর্সেনিক : দেশের অনেক অঞ্চলে খাবার পানিতে আর্সেনিকের মতো মারাত্মক রাসায়নিক পদার্থের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। তথ্যটি যে কোনো নাগরিকের জন্য উদ্বেগজনক বিষয়। কারণ আর্সেনিক সরাসরি পাকস্থলীতে গেলে সাথে সাথে মৃত্যু ঘটতে পারে।
৪. শব্দদূষণ : শব্দদূষণ আজকাল এক ভয়াবহ সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। আমরা প্রতিদিন হাইড্রোলিক হর্নের কর্কশ শব্দে বাস করছি, যা ধীরে ধীরে আমাদের কানের পর্দায় চাপ সৃষ্টি করে শ্রবণশক্তি নষ্ট করছে। এর সঙ্গে মাইকের উচ্চ শব্দ ও কলকারখানার আওয়াজ আরও যোগ হয়ে পরিস্থিতি করছে জটিল। ফলে শুধু শ্রবণ সমস্যা নয়, নানা ধরনের শারীরিক ও মানসিক অসুস্থতাও বাড়ছে। এই শব্দদূষণ আমাদের পরিবেশ দূষণকে আরও মারাত্মক করে তুলছে।
৫. রাসায়নিক ও কীটনাশকের ব্যাপক ব্যবহার : ভালো ও উন্নত জাতের ফসল ফলানোর জন্য এবং কীটপতঙ্গের হাত থেকে ফসলকে রক্ষার জন্য কৃষকরা অপরিকল্পিতভাবে এবং কীটপতঙ্গের হাত থেকে ফসলকে রক্ষার জন্য ব্যবহার করছে। এগুলো অতিমাত্রায় ব্যবহারের দরুন জীবজগৎ, প্রাণিজগৎ এবং পরিবেশ মারাত্মক হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে।
পরিবেশ দূষণের ক্ষতিকর প্রভাব : ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা, শিল্পায়ন, নগরায়ণ, অবাধ বৃক্ষনিধন এবং পরিবেশ রক্ষায় সচেতনতার অভাবে আমাদের পরিবেশ এখন বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়ছে। কলকারখানা ও যানবাহনের ক্ষতিকর ধোঁয়া, ইটভাটার কালো ধোঁয়া এবং শিল্পের বিষাক্ত বর্জ্যের কারণে বাংলাদেশের পরিবেশ মারাত্মক হুমকির মুখে। বৃক্ষনিধনের ফলে বাতাসে অক্সিজেনের পরিমাণ কমছে, বাড়ছে দূষণ, হারিয়ে যাচ্ছে নানা প্রজাতির পাখি ও বনজ প্রাণী। নদীর পানিও দূষিত হয়ে মাছের সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে। এর ফলে পরিবেশ দূষিত হয়ে ভারসাম্য হারাচ্ছে এবং মানুষের জীবনযাপন ক্রমেই কঠিন হয়ে উঠছে।
পরিবেশ সমস্যার সমাধান : পরিবেশ সমস্যা বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা। তাই এই সমস্যার সমাধান আশু প্রয়োজন। নিচে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে পরিবেশ সমস্যার সমাধান আলোচনা করা হলো :
১. বনায়ন : পরিবেশ সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে বনায়ন বিশেষ ভূমিকা পালন করে। তাই পরিবেশ দূষণের মরণ ছোবল থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য বনায়ন করা দেশের সচেতন প্রত্যেকটি নাগরিকের কর্তব্য।
২. শব্দদূষণ রোধ : হাইড্রোলিক হর্ন এবঙ যত্রতত্র মাইক বাজানোর বিরুদ্ধে সরকার যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করলে শব্দদূষণের কবল থেকে অনেকাংশে রক্ষা পাওয়া যাবে বলে মনে হয়। হাইড্রোলিক হর্নের ব্যবহারের ক্ষেত্রে আইন প্রণয়ন করা হলেও বর্তমানে তা কাগুজে বাঘ হয়ে আছে। সুতরাং বর্তমান সরকারের উচিত জাতীয় স্বার্থে শব্দদূষণ রোধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
৩. পলিথিন বর্জন : পলিথিন পরিহার করা পরিবেশ রক্ষার স্বার্থে দেশের প্রতিটি মানুষের কর্তব্য। নব্বই সালের গোড়ার দিকে দেশে পলিথিন উৎপাদন বন্ধের ব্যাপারে তৎকালীন সরকার একটি উদ্যোগ গ্রহণ করে। কিন্তু পরে রাজনৈতিক জটিলতা এবং ভোট নষ্ট হবার আশঙ্কায় সিদ্ধান্তটির মৃত্যু ঘটে। সম্প্রতি পলিথিন ব্যাগ নিষিদ্ধ করা হলেও এর ব্যবহার কমবেশি এখনো চলছে। এ ব্যাপারে প্রশাসনকে আরো কঠোর ভূমিকা পালন করতে হবে।
৪. পরিবেশ আইনের প্রয়োগ : অন্যান্য দেশের মতো আমাদের দেশেও পরিবেশ রক্ষার জন্য নানা আইন রয়েছে। যদি পরিবেশ অধিদপ্তর এসব আইন সঠিকভাবে কার্যকর করে এবং পরিবেশ দূষণ সম্পর্কে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি ও জনমত গঠনের উদ্যোগ নেয়, তাহলে আমরা নিশ্চয়ই পরিবেশ বিপর্যয়ের হাত থেকে অনেকটাই নিরাপদ থাকতে পারব।
৫. সচেতনতা বৃদ্ধি : পরিবেশ বিপর্যয়ের সমস্যা সামগ্রিকভাবে একটি দেশের জাতীয় সমস্যা। কাজেই এই সমস্যা থেকে জাতিকে মুক্ত করার জন্য কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা বিশেষ আইনই যথেষ্ট নয়, এজন্য দরকার দেশের সমগ্র জনগণের চেতনাবোধ। দেশের জনগণ যদি পরিবেশ বিপর্যয়ের সমস্যা সম্পর্কে সচেতন হন, তাহলে পরিবেশ বিপর্যয়ের কবল থেকে আমরা অতি সহজেই নিজেদের অস্তিত্বকে রক্ষা করতে পারব।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায়, পরিবেশ বিপর্যয়ের মতো নিঃশব্দ শত্রুর হাত থেকে দেশকে রক্ষা করতে হলে আমাদের এখনই উদ্যোগী হওয়া প্রয়োজন। তাই বর্তমান সরকারের উচিত রাজনৈতিক দক্ষতা, সকলের ম্যান্ডেট আর সমন্বিত প্রশাসনিক পদক্ষেপকে কাজে লাগিয়ে বিপন্ন পরিবেশের মরণ ছোবল থেকে দেশবাসীকে রক্ষা করা এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি নিরাপদ ও সুন্দর স্বদেশভূমি নিশ্চিত করা।
এই রচনাটি অন্য বই থেকেও সংগ্রহ করে দেয়া হলো
ভূমিকা: মানুষের চারপাশে যা কিছু রয়েছে, তাই তার পরিবেশ। এই পরিবেশ দুই ধরনের— প্রাকৃতিক পরিবেশ ও মানবসৃষ্ট পরিবেশ। সভ্যতার অগ্রগতির সাথে সাথে মানুষ নিজে গড়ে তুলেছে নিজের পরিবেশ। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রগতিতে মানুষ এখন অনেকটা পরিবেশের নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠেছে, কিন্তু একই সঙ্গে নিজের স্বার্থে পরিবেশকে ধ্বংসও করছে। এর ফলেই প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
পরিবেশ দূষণের কারণ: জনসংখ্যা বৃদ্ধি পরিবেশ দূষণের অন্যতম কারণ। জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে প্রাকৃতিক সম্পদ জল-মাটি-বায়ুর ওপর পড়েছে প্রচণ্ড চাহিদার চাপ। একই সঙ্গে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে উদ্ভিদজগৎ ও প্রাণিজগৎ। প্রকৃতি ও পরিবেশের ভারসাম্য এসে পৌঁছেছে এক সংকটজনক অবস্থায়। শক্তি উৎপাদনের সাথে সাথে নির্গত হয় মানুষের স্বাস্থ্য ও পরিবেশ-দূষক নানা রাসায়নিক পদার্থ। রাসায়নিক দ্রব্যই নানা দুরারোগ্য ব্যাধির দ্রুত প্রসারণের কারণ। এতে বায়ু, জল, খাদ্যদ্রব্য মারাত্মকভাবে দূষিত হচ্ছে।
পরিবেশ দূষণের ধরন: আমাদের পরিবেশ দূষণকারী অপদ্রব্যগুলো মোটামুটি দুই ভাগে বিভক্ত। এক প্রাকৃতিক, দুই কৃত্রিম । প্রাকৃতিক দূষণের মধ্যে রয়েছে সিসা, পারদ, সালফার ডাই-অক্সাইড, কার্বন ডাই-অক্সাইড, কার্বন মনোক্সাইড ইত্যাদি। কৃত্রিম-দূষকের অন্তর্গত হলো নানা কীটনাশক, গুঁড়ো সাবান, ঔষধপত্র ও প্রসাধনসামগ্রী, এমনকি প্লাস্টিকও। এসব যৌগের কয়েকটি আমাদের পরিবেশে বহুদিন ধরে টিকে থাকে। রোদ, জল, বাতাস, জীবাণু এর কোনো ক্ষতিই করতে পারে না। এ ধরনের যৌগ নিয়েই পরিবেশ-বিজ্ঞানীদের দুশ্চিন্তা বেশি। কেননা, কিছুদিন আগেও পৃথিবীর বুকে এ ধরনের যৌগের অস্তিত্ব ছিল না।
বায়ুদূষণ: আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো বায়ু। আজ বায়ুদূষণ সারা বিশ্বজুড়ে একটি বড় সমস্যা। ঝুলজাতীয় কার্বন কণা, ভারী ধাতু, জটিল জৈব যৌগ, নিউক্লীয় বর্জ্য এবং জীবাশ্ম জ্বালানি যেমন তেল ও কয়লা পোড়ানোর ফলে বাতাসে ছড়িয়ে পড়ছে কার্বন ডাই-অক্সাইড, ক্লোরোফ্লোরোমিথেন, নাইট্রাস অক্সাইড ও অন্যান্য রাসায়নিক ধোঁয়া। এই কারণে বাতাসে কার্বন ডাই-অক্সাইডের মাত্রা ক্রমেই বেড়ে চলেছে, যার প্রভাবে আবহাওয়ার তাপমাত্রা বাড়ছে। অকাল-বর্ষণ, ঝড়ঝঞ্ঝা ও কুয়াশা এরই ফল। এমন আবহাওয়ায় চাষাবাদও অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে। তেল ও কয়লার দহনের সঙ্গে কুয়াশার মিশ্রণে ধোঁয়াশার সৃষ্টি হয়, যা মাথা ব্যথা, শ্বাসকষ্ট, হাঁপানি, দীর্ঘস্থায়ী ব্রংকাইটিস এবং ফুসফুসের ক্যানসারের মতো সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
পানি দূষণ: পানিদূষণ আধুনিক সভ্যতার আর এক অভিশাপ। পৃথিবীর সমুদ্র, নদনদী, পুকুর, খালবিল ইত্যাদির পানি নানাভাবে দূষিত হচ্ছে। ভারী ধাতু, হ্যালোজেন নিষিক্ত হাইড্রোকার্বন, কার্বন ডাই-অক্সাইড, পেট্রোলিয়াম, কৃত্রিম তেজস্ক্রিয় উপাদান, সর্বোপরি সংলগ্ন শহরের নির্গমন নালি বেয়ে আসা দূষিত তরল আবর্জনা— এগুলোই হলো সমুদ্র দূষণের প্রধান উপকরণ। তাছাড়া নদীর তীরে গড়ে উঠেছে সমৃদ্ধ জনপদ, শহর । প্রতিষ্ঠিত হয়েছে আধুনিক চটকল, কাপড় কল, কয়লা ধোলাই কল, চিনি কল, কাগজের কল, ভেষজ তেল তৈরির কারখানা, চামড়া পাকা করার কারখানা ইত্যাদি। এসব কলকারখানার বর্জ্য পদার্থ প্রতিনিয়ত নদনদীকে দূষিত করছে। পুকুর, খালবিল দূষণের জন্য নালা-নর্দমা, ঘরবাড়ির আবর্জনা ইত্যাদি দায়ী। এর থেকেই দূষিত হয় মাটি, দূষিত হয়। পানীয়জল । সমুদ্র, নদী, খালবিল, পুকুরের মাছেও নানারূপ দূষণ ঘটছে। ছড়িয়ে পড়ছে নানারকমের সংক্রামক রোগ। মাঝে মাঝে তা মহামারি আকার ধারণ করে। মৃত্যু এসে ছিনিয়ে নিয়ে যায় অসংখ্য জীবন। এমন করেই দিনের পর দিন জনস্বাস্থ্য বিনষ্ট হচ্ছে।
শব্দদূষণ: শব্দদূষণ এ যুগের এক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। শহরে শব্দদূষণের মাত্রা সর্বাধিক। প্রতিনিয়তই এখানে মোটরগাড়ির হর্ন, কলকারখানার বিকট আওয়াজ, বাজিপটকার শব্দ, রেডিও, টেলিভিশনের শব্দ, লোকজনের চিৎকার-চেঁচামেচি, উৎসবের মত্ততা, মাইকে চড়া সুর, সব মিলেমিশে শব্দদূষণ সৃষ্টির মহাযজ্ঞ চলছে। শব্দদূষণের পরিণাম ভয়াবহ। এর ফলে অনেক ক্ষেত্রে শ্রবণ-ক্ষমতার বিলোপ ঘটে। মানসিক বিপর্যয় দেখা যায়, রক্তচাপ বেড়ে যায়। অনিদ্রা রোগের শিকার হয় মানুষ। শব্দের ২০ থেকে ৪০ ডেসিবল পর্যন্ত মাত্রা হলো স্বাভাবিক।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে পরিবেশ দূষণ: বাংলাদেশের পরিবেশ নানা কারণে দূষিত হচ্ছে। এর প্রধান কারণ দুটি। যথা— ক. প্রাকৃতিক কারণ এবং খ. মানবসৃষ্ট কারণ।
ক. প্রাকৃতিক কারণ: বাংলাদেশ কর্কটক্রান্তি রেখায় অবস্থিত একটি দেশ। অতিবৃষ্টি, ঝড়, জলোচ্ছ্বাস, টর্নোডো, সাইক্লোন ইত্যাদি নানারকমের দুর্যোগ এ দেশের নিত্যসঙ্গী। নিম্নে বাংলাদেশের পরিবেশ দূষণের প্রাকৃতিক কিছু কারণ দেওয়া হলো-
ঝড়-বৃষ্টি-বন্যা: উত্তরের হিমালয় পর্বত থেকে ধেয়ে আসা পাহাড়ি ঢলের কারণে প্রায়ই দেখা যায় বন্যা। বাংলাদেশে দীর্ঘমেয়াদি বন্যার কারণে দেখা দেয় পরিবেশ বিপর্যয়। বন্যার পানিতে ভেসে আসা মৃত জীবজন্তু লোকালয়ের পরিবেশে দূষণ করে। এগুলোর গলিতাংশ পানিতে মিশে পানি দূষণ করে । বন্যা পরবর্তী সময়েও এ দূষণ ক্রিয়াশীল থাকে। কারণ খালবিল, ডোবা-নালায় বন্যার পানি আটকে থাকায় দূষিত পানি অনেকদিন থেকে যায়। ফলে পরিবেশের ওপর এর প্রভাব পরে। এছাড়া ঝড়ের সময় পশুপাখি ও প্রাণীর মৃত্যু ঘটে থাকে। এসব মৃত প্রাণী পরিবেশ দূষণ করে ।
জলাবদ্ধতা: অতিবৃষ্টির কারণে বাংলাদেশে বিশেষত শহরাঞ্চলে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। বদ্ধ পানিতে প্রাণীর মৃতদেহ এবং ড্রেন থেকে আসা ময়লা-আবর্জনা পরিবেশ দূষণ করে। পানি স্থির থাকে বলে এসব বর্জ্য শহরের রাস্তাঘাট বা অলিগলিতে পানি নিষ্কাশনের সুব্যবস্থা না থাকায় পরিবেশ বিপর্যয়ের মুখে পতিত হয়। এছাড়া দূষিত পানির মাধ্যমে রোগ-জীবাণু ছড়িয়ে পড়ে ।
খ. মানবসৃষ্ট কারণ: পরিবেশ দূষণে প্রাকৃতিক কারণের চেয়ে মানবসৃষ্ট কারণই বেশি দায়ী। পরিবেশ দূষণের মানবসৃষ্ট কিছু কারণ নিচে উল্লেখ করা হলো—
কলকারখানা: গত কয়েক দশক ধরে বাংলাদেশে দ্রুত শিল্পায়ন ও নগরায়ণ হচ্ছে। শিল্পায়নের ফলে গড়ে ওঠা কলকারখানা পরিবেশ দূষণের একটি বড় কারণ। কলকারখানায় ব্যবহৃত জীবাশ্ম জ্বালানি এবং রাসায়নিক পদার্থ বায়ু- পানি-মাটির সাথে মিশে পরিবেশ দূষণ করছে। কারখানার বর্জ্য- ব্যবস্থাপনায় আধুনিকায় না ঘটায় কারখানার বর্জ্য পরিবেশের বিভিন্ন উপাদানের সাথে মিশে পরিবেশ দূষণ করছে।
বিদ্যুৎ উৎপাদন: কলকারখানা ও বসতবাড়িতে বিদ্যুতের চাহিদা মেটাতে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে হয়। বাংলাদেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনে যেসব পদ্ধতি ব্যবহার হয় তা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। কয়লাভিত্তিক বা গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ-উৎপাদন কেন্দ্রগুলো প্রচুর বিষাক্ত গ্যাস নির্গমন করে। এসব গ্যাস বায়ুমণ্ডলে মিশে বায়ুমণ্ডলের ক্ষতি করে। এছাড়া কয়লা উত্তোলনে বাংলাদেশ ‘উন্মুক্ত পদ্ধতি' ব্যবহার করে, যা পরিবেশের অন্যতম উপাদান মাটির ক্ষয় সাধন করে। এর ফলে প্রায়ই ভূমিধস দেখা যায়।
কৃষিক্ষেত্রে রাসায়নিক সারের ব্যবহার: বাংলাদেশে কৃষির আধুনিকায়ন মূলত রাসায়নিক সার ব্যবহারের উপর নির্ভরশীল। এই রাসায়নিক সার মাটি ও পানি দূষণের প্রধান কারণ। মিথেন বা নাইট্রোজেনের মতো গ্যাস ব্যবহার করে সার উৎপাদনের সময় এসব গ্যাস মাটি ও পানিতে মিশে পরিবেশকে দূষিত করে। এছাড়াও, কৃষিক্ষেত্রে কীটনাশক ব্যবহারের ফলে পরিবেশ আরও দূষিত হয়।
যানবাহনের কালো ধোঁয়া: যানবাহন থেকে নির্গত কালো ধোঁয়া বাংলাদেশের বিশেষত শহরাঞ্চলের পরিবেশ দূষণ করে চলছে। ডিজেল চালিত যানবাহন থেকে নির্গত কার্বন-মনো অক্সাইড (CO) শহরের বাতাস অত্যধিক। এর সাথে কালো ধোঁয়ার কারণে বাতাসে সিসার মতো ক্ষতিকর পদার্থ মিশে যাচ্ছে। এছাড়া হর্ন বাজানোর নির্দিষ্ট নিয়ম না থাকায় শব্দ দূষণ হচ্ছে।
ইটভাটা: বাংলাদেশে ইটভাটা তৈরির নীতিমালা থাকলেও তা অনুসরণ করা হয় না। যত্রতত্র গড়ে ওঠা ইটভাটা পরিবেশের ক্ষতি করছে। ইটভাটা থেকে নির্গত কালো ধোঁয়া পরিবেশ দূষণ করে। আবার ইটভাটায় জালানি কাঠ পোড়ানোর ফলে নাইট্রোজেন গ্যাস বাতাসে মিশে যাচ্ছে । ফলে পরিবেশ দূষণ হচ্ছে ।
দূষণের প্রতিকার: দূষণের ভয়াবহ পরিণামের কথা ভেবে বিশ্বের সভ্য মানুষ আজ আতঙ্কিত। কী উপায়ে এ ভয়ংকর সমস্যার মোকাবিলা সম্ভব তা নিয়ে ভাবনা-পরিকল্পনার শেষ নেই। বায়ুদূষণের প্রতিকারের জন্য গ্রহণ করা হয়েছে কলকারখানার দহন-প্রক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করে নির্গত দূষকের পরিমাণ কমানোর ব্যবস্থা। চেষ্টা চলছে নির্দিষ্ট এলাকায় যাতে দূষণের প্রভাব ঘনীভূত না হয় তার জন্য দূষকগুলোকে আরও বড় এলাকাজুড়ে ছড়িয়ে দেওয়ার। চেষ্টা চলছে দহনে উৎপন্ন গ্যাসে অতিরিক্ত কোনো পদার্থ মিশিয়ে দেওয়ার, যাতে নির্গত হওয়ার আগেই কোনো কোনো দূষক অপসারিত হতে পারে । তাছাড়া গ্রহণ করা হয়েছে বৃক্ষরোপণ পরিকল্পনা। দূষণ-প্রতিরোধী উদ্ভিদের ব্যবহার খুবই জরুরি। সমুদ্রদূষণের প্রতিকারের জন্য প্রয়োজন বিভিন্ন উপদ্বীপ ও উপকূলীয় অঞ্চলে সমুদ্র দূষণের পরিমাণ নিয়মিত পরিমাপ করা, শব্দদূষণের কুপ্রভাব কমানোর প্রধান উপায় হলো শব্দের ব্যবহার সম্পর্কে জনসাধারণকে সচেতন করে তোলা। প্রযুক্তিবিদ্যার সাম্প্রতিক অগ্রগতিতে এমন কতকগুলো পদ্ধতির উদ্ভাবন হয়েছে, যাতে পরমাণু চুল্লির আবর্জনা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হয়েছে। এর ফলে নিউক্লীয় বিদ্যুৎকেন্দ্রের পরিবেশে কোনো তেজস্ক্রিয় থাকবে না ।
উপসংহার: পরিবেশ দূষণ সমস্যা নিয়ে আজ সকল দেশই চিন্তিত। মানবসভ্যতার অস্তিত্বই আজ সংকটের মুখোমুখি। ১৯৭২ সালে ‘মানুষের পরিবেশ' নিয়ে সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের অধিবেশন হয় স্টকহোমে। ১৯৯২ সালে ব্রাজিলের রিও ডি জেনিরোতে অনুষ্ঠিত হয়েছে বারো দিনব্যাপী ধরিত্রী সম্মেলন । আমেরিকা, রাশিয়া, সুইডেন, জার্মানি, জাপান, সিঙ্গাপুর ও অন্যান্য বহুদেশে জাতীয় স্তরে গঠিত হয়েছে পরিবেশ সংস্থা। বাংলাদেশের সংবিধানেও পরিবেশ দূষণ প্রতিরোধের শর্ত আরোপ করা হয়েছে। এখানেও প্রতিবছর ৫ই জুন বিশ্ব পরিবেশ দিবসরূপে পালিত হচ্ছে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি নিরাপদ পৃথিবী গড়ে তোলার লক্ষ্যে যেকোনো মূল্যে পরিবেশ দূষণ রোধ করার প্রয়োজন অনস্বীকার্য।
আপনি যদি আরও রচনা পড়তে চান, তাহলে আমার ওয়েবসাইট StudyTika.com-এ যান এবং অন্যান্য রচনাগুলি পড়ুন।