এই ব্লগপোস্টে রয়েছে “যুদ্ধ নয়, শান্তি চাই” শিরোনামে একটি সুন্দর রচনা। সহজ ভাষায় লেখা এই রচনাটি ক্লাস ৭ থেকে শুরু করে এইচএসসি পর্যন্ত সব শিক্ষার্থীদের জন্য উপযুক্ত।
যুদ্ধ নয়, শান্তি চাই রচনা
ভূমিকা
বর্তমান দুনিয়া পরাক্রমশালী বিভিন্ন রাষ্ট্রের পারমাণবিক মরণযুদ্ধের আয়োজনে ত্রস্ত, শঙ্কিত। তবুও আধুনিক মারণাস্ত্রের ধূমায়িত সমস্যার মধ্যেই শান্তির দীপশিখাটি প্রজ্বলিত। রণদামামার মাঝেও শান্তির বাণী ধ্বনিত হয় যুদ্ধ নয় শান্তি চাই, মৃত্যু নয় জীবন চাই। শান্তিকামীদের শ্লোগান: Live and let live. একবিংশ শতকের প্রথম পাদে দাঁড়িয়ে বিশ্ব আজ প্রকৃত প্রস্তাবে যুদ্ধ ও শান্তির সন্ধিলগ্নের মুখোমুখি। শান্তি চায় না এমন কথা বিশ্বশান্তির বিরুদ্ধবাদীরাও মুখে আনবে না। তবু বিশ্ব আজ চরম সংকটের ভিতর দিয়ে চলছে। পরাশক্তির অধিকারী দেশগুলোর অস্ত্র প্রতিযোগিতায় ভাটা পড়ে নি। নিত্যনতুন মারণাস্ত্র নির্মাণের ব্যয়ভার কমাতে কোনো পরাশক্তিই আজ পর্যন্ত আগ্রহ দেখায় নি। তাদের সামরিক শক্তির দম্ভে একের পর এক অঞ্চল উপদ্রুত হয়ে পড়ছে। এ অবস্থায়ও আমরা বলতে চাই – যুদ্ধ নয় শান্তি চাই ।
প্রাচীন যুদ্ধ
প্রাচীন মহাকাব্যগুলো হলো যুদ্ধের কাব্য। প্রাচীন যুগ থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত প্রতিটি সভ্যতার অঙ্কুরোদগম হয়েছে যুদ্ধের মধ্য দিয়ে। আধুনিক সমাজের সুমহান আদর্শ স্বাধীনতা, ভ্রাতৃত্ব, মৈত্রী, সমাজবাদ ইত্যাদি বিপ্লবের মধ্য দিয়েই বারবার নিজ মূল্য যাচাই করে নিয়েছে। খুঁজেছে শান্তির পথ।
পারমাণবিক যুদ্ধ
যষ্ঠদশ-সপ্তদশ শতকের ধর্মযুদ্ধ বা উনিশ শতকের জাতীয়তাবাদের যুদ্ধের তুলনায় বিশ শতকের যুদ্ধ অতি নৃশংস। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের বিশ বছর পরেই আবার রক্তাগ্নিশিখা প্রজ্বলিত করে শুরু হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। জার্মান, জাপান, ইতালি অক্ষশক্তির বিরুদ্ধে মিত্রশক্তির প্রতিরোধ এ যুদ্ধে শান্তিকামী মানুষের গলায় জয়মাল্য পরিয়েছিল, কিন্তু ১৯৪৫ সালের সেই কলঙ্কিত দিন দুটিতেই ‘৬ ও ৯ আগস্ট’ হিরোসিমা-নাগাসাকিতে পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণ, অগণিত মানুষের বীভৎস চিতাশয্যা রচনা করে। তারপর শুরু হয় পারমাণবিক মারণাস্ত্র তৈরির প্রতিযোগিতা।
বিভিন্ন যুদ্ধে বিশ্বের ধ্বংসাত্মক রূপ
হিরোসিমা-নাগাসাকির গণকবরের নির্মমতায় আজ সভ্যতা ম্রিয়মাণ। তবুও আজকের আগ্রাসী সাম্রাজ্যবাদী সভ্যতা তার মারণযজ্ঞের হোমানল প্রজ্বলিত করে চলেছে পারমাণবিক বোমা তৈরি করে। যেই বোমার বিস্ফোরণ ক্ষমতা ১২ মিলিয়ন টন টি. এন, টি। ১৯৪৫ সালে যে বোমা বিস্ফোরণ হয় তার ক্ষমতা ছিল ২০ হাজার টন টি,এন,টি। যুদ্ধাস্ত্রের ধ্বংসাত্মক ক্ষমতা দ্রুত হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ১০টি আণবিক বোমা বহনকারী MX আন্তঃমহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্রের প্রত্যেকটি বোমা ৬,০০,০০০ টন টি.এন.টি, ক্ষমতা যুক্ত। নির্দিষ্ট নিশানায় আঘাত হানতে পাশি-২, ক্রুজ- ২ ক্ষেপণাস্ত্রের সময় লাগে মাত্র ৪-৬ মিনিট, আধুনিক নিউট্রন বোমার বিস্ফোরণ ১,৪০০ মিটার দূরবর্তী স্থানে বসবাসকারী মানুষকেও মহাশশ্মশানের চিরনিদ্রায় মগ্ন করবে। কয়েক বছর আগের হিসাব অনুযায়ী পৃথিবীতে প্রতিবছর ৪,০০,০০০ মিলিয়ন ডলার ধ্বংসাত্মক অস্ত্রনির্মাণের জন্যে ব্যয় করা হয়। ৪৫-এর পর বিশ্বযুদ্ধের রণলিপ্সা স্তিমিত হলেও বিচ্ছিন্ন যুদ্ধের রণদামামা শ্রবণে পৃথিবী আজ আতঙ্কিত। মহাযুদ্ধের মহাপ্রান্তরে আমরা প্রত্যক্ষ করেছি কোরিয়ার যুদ্ধ, বঙ্গোযুদ্ধ, ৬২-র কিউবা সংকট, ভিয়েতনামে মার্কিনের নৃশংসতা, আফগানিস্তানের নৃশংসতা। আরও যুদ্ধ আছে- আরব-ইসরাইল যুদ্ধ। ইরান-ইরাকের যুদ্ধ খেলা। ১৯৯১ সালে উপসাগরীয় সংকটকে কেন্দ্র করে ইরাকের বিরুদ্ধে বহুজাতিক বাহিনীর রণোন্মত্ততা। ২০০৩ সালের শুরুতে ইরাকে চলেছে ইঙ্গ-মার্কিন বাহিনীর নৃশংস অগ্রাসন। ফিলিস্তিনে চলছে মার্কিন মদদপুষ্ট ইসরাইলের নিষ্ঠুর বর্বরতা। ইউক্রেনে চলছে রাশিয়া বনাম যুক্তরাষ্ট্র তার মিত্রদের শক্তি পরীক্ষা।
যুদ্ধ কেনো বাঁধে
মানুষের জীবনে টিকে থাকার জন্য সংগ্রাম অপরিহার্য। এই সংগ্রাম আত্মসম্মান ও অস্তিত্ব রক্ষার জন্য, অন্যকে ধ্বংস করার জন্য নয়। কিন্তু বর্তমান বিশ্বে যুদ্ধের রূপ হয়ে উঠেছে একে অপরকে পরাজিত ও ধ্বংস করার লড়াই। মানুষের হিংসা, দ্বেষ ও সীমাহীন লোভ-লালসা আজ তাকে বিপথে ঠেলে দিচ্ছে। মানুষ সন্তুষ্ট নয় তার প্রাপ্তিতে; সে চায় আরও, চায় অন্যকে পদানত করতে। এই সম্প্রসারণবাদই আজকের বিশ্বের অধিকাংশ সংঘাত ও যুদ্ধের মূল কারণ। বিশ শতকে সংঘটিত দুটি বিশ্বযুদ্ধের মূলেও ছিল এই সম্প্রসারণশীলতা। তাই বলা যায়, যুদ্ধের প্রকৃত শিকড় লুকিয়ে আছে মানুষের অতি চাহিদা ও ক্ষমতা প্রসারের অন্ধ লালসায়।
যুদ্ধের পরিণাম
যুদ্ধের ফলে ধ্বংস হয়ে গেছে অগণিত জনপদ, অসংখ্য মানুষ। বিজ্ঞানের ব্যাপক অগ্রগতি মানুষের জীবনে যুদ্ধের মাধ্যমে নিয়ে এসেছে সর্বনাশা ও ভয়াবহ ধ্বংসলীলা। তাই আজকের দিনে যুদ্ধবিগ্রহের ক্ষয়ক্ষতি ব্যাপক ও সুদূরপ্রসারী। শক্তির সাধনায় আজকের বিশ্ব দুটি প্রধান রাষ্ট্র আমেরিকা ও রাশিয়ার পৃথক পৃথক জোটে আবদ্ধ হয়ে আছে। নিজের প্রাধান্য বজায় রাখার জন্য এ বৃহৎ শক্তি দুটি অনবরত যুদ্ধ সাজে সজ্জিত হচ্ছে। প্রতিদিন আবিষ্কৃত হচ্ছে নিত্যনতুন মারণাস্ত্র। ফলে সারা বিশ্বে এখন অস্ত্রের ঝনঝনানি। ফিলিস্তিনে অনুষ্ঠিত হচ্ছে মানব ইতিহাসের জঘন্যতম অপরাধ; আগ্রাসনী ইসরাইল শক্তির মত্ততায় ন্যায়নীতি বিসর্জন দিচ্ছে। আমেরিকার ইরাক ও আফগানিস্তান আক্রমণে অসংখ্য লোক নিহত হয়েছে, নষ্ট হয়েছে অনেক স্থাপত্য শিল্প, গণতন্ত্রের নামে মানবতার চরম অবমূল্যায়ন ঘটেছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য ত্রিশ লক্ষ লোককে শহিদ হতে হয়েছে। সর্বনাশা যুদ্ধের পরিণাম ভয়াবহ আকারে মানুষের জীবনকে বিপর্যস্ত করে দিচ্ছে। যুদ্ধের ধ্বংসলীলায় নিশ্চিহ্ন হয় বস্তু জনপদ, ফসলের বিরাট মাঠ পুড়ে আবাদের অযোগ্য হয়ে যায়। বোমার কবলে পড়ে অসংখ্য মানুষের জীবনের অবসান ঘটে। কলকারখানা, বাড়িঘর ইত্যাদির ক্ষয়ক্ষতির কোন তুলনা থাকে না। এ সর্বগ্রাসী ধ্বংসলীলা থেকে মানুষকে রক্ষা করতে না পারলে বিশ্বের সভ্যতার অবসান অনিবার্য।
যুদ্ধের অবসান কেন হয় না
যুদ্ধের ভয়াবহতা থেকে রক্ষা পেতে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর প্রতিষ্ঠিত হয় ‘লীগ অব নেশনস’ এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর গঠিত হয় ‘জাতিসংঘ’। জাতিসংঘের লক্ষ্য ছিল বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠা, তবে বাস্তবে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশগুলোর ক্ষেত্রে এটি কার্যকর ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হয়েছে। পরাশক্তিগুলোর মধ্যে নিরস্ত্রীকরণের লক্ষ্যে ন্যাটো, ওয়ারশ চুক্তি, পারমাণবিক পরীক্ষা নিষিদ্ধকরণ ও অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তিসহ নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ১৯৮৫ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিগ্যান ও সোভিয়েত নেতা গর্বাচেভ শান্তি আলোচনায় মিলিত হলেও পরস্পরের শ্রেষ্ঠত্ব ছাড়তে অনিচ্ছার কারণে স্থায়ী শান্তি আজও অধরা। অনুন্নত যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশগুলোর ওপর পরাশক্তিগুলোর প্রভাবও শান্তি প্রতিষ্ঠায় বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে শান্তির জন্য মানুষের আকাঙ্ক্ষা থাকলেও তা বিশ্বব্যাপী বাস্তবায়িত হচ্ছে না।
যুদ্ধ নয় শান্তি
যুদ্ধের ধ্বংসলীলা থেকে মুক্ত হয়ে পৃথিবীতে স্থাপন করতে হবে শান্তির রাজ্য। মানুষের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে এই শান্তি অপরিহার্য। তাই শুভবুদ্ধিসম্পন্ন সকল মানুষকে একত্র হয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা চালাতে হবে। বিশ্বে শক্তিধর রাষ্ট্রগুলো যে বিপুল অর্থ অস্ত্র প্রতিযোগিতায় ব্যয় করছে, তা বন্ধ করে সেই অর্থ দুঃখী ও অসহায় মানুষের কল্যাণে ব্যবহার করা উচিত। যুদ্ধ রোধে সারা বিশ্বের জনগণকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। বর্ণবিদ্বেষ, জাতিগত বিদ্বেষ ও সাম্রাজ্যবাদের সকল চিহ্ন মুছে ফেলতে হবে। আধিপত্যবাদ ও ঔপনিবেশিক মানসিকতা পরিত্যাগ করতে হবে শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোকে। যুদ্ধবিরোধী জনমত গঠনের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী শান্তি প্রতিষ্ঠায় জাতিসংঘের কার্যক্রম বাস্তবায়নে সহায়তা করতে হবে। কেবলমাত্র পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও মানবিক চেতনার ভিত্তিতেই গড়ে উঠতে পারে একটি যুদ্ধহীন শান্তিময় বিশ্ব।
বিশ্বের বেশিরভাগ মানুষ আজ শান্তি চায়। কারণ শান্তিতেই আছে মানবজীবনের পরিপূর্ণ সমৃদ্ধি। শান্তি বিরাজমান থাকলে শিক্ষা, সভ্যতা ও সংস্কৃতির বিকাশ ঘটে। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি তথন অসম্ভর মনে হবে না। সামাজিক জীবন হবে নির্বিঘ্ন। তাই আমাদের শেষ কথা-যুদ্ধ নয় শান্তি চাই, মৃত্যু নয় জীবন চাই।
উপসংহার
শান্তিই পারে বিশ্বকে সমৃদ্ধি ও কল্যাণে ভরিয়ে দিতে। যুদ্ধ কখনোই শুভ পরিণতি বয়ে আনে না। শান্তি সকল মানুষের কাম্য হওয়া উচিত। তবে মানুষের অন্তরে যদি সৎ চিন্তা না থাকে, যদি হিংসা, লোভ ও বিদ্বেষ থেকে মুক্ত না হওয়া যায়, তাহলে শান্তি চিরকালই থেকে যাবে অধরা, এক সোনার হরিণের মতো। অন্তরে বিষ লালন করে বাইরে শান্তির বাণী প্রচার করা একপ্রকার প্রহসনেরই নামান্তর। যদি পৃথিবীর সকল জাতি একে অপরের স্বাধীনতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়, পারস্পরিক সহনশীলতা ও ভ্রাতৃত্ববোধে একত্রিত হতে পারে, তবেই পৃথিবীতে বইবে শান্তির সুবাতাস। আজ বিশ্বব্যাপী কোটি কোটি মানুষ সেই শুভ দিনের প্রতীক্ষায় অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে—যেদিন মানবতা জয়ী হবে, আর শান্তিই হবে পৃথিবীর মূল ভাষা।
রচনাটি পড়ার জন্য ধন্যবাদ। আরও সহজ ও সুন্দর রচনা পড়তে ভিজিট করুন আমার ওয়েবসাইট — StudyTika.com।